সকাল থেকেই হালিমা বেগমের মুখটি কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। সবাই ব্যাপারটি লক্ষ করেছে। পাশের বেডের রোকেয়া বেগম এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে হালিমা বুবু।
রোকেয়া বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, কিছু হয়নি বুবু।
তাহলে মুখটি এত বেজার কেন? শরীরটা খারাপ হলো নাকি?
না কিছু হয়নি।
আহা বুবু, কিছু তো হয়েছেই। একবার খুলে বলো না।
কী আর হবে বোন, কতদিন ছেলেটার খবর পাই না। তিন বছর ধরে কোনো চিঠিপত্রও দেয় না। ফোনও করে না। একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলাম। ছেলেটা আমার কেমন আছে কে জানে!
যে ছেলে তোমার কোনো খবর রাখে না তার জন্য তুমি চিন্তা করছ? তোমাকে এখানে রেখে সেই সুদূর আমেরিকায় পাড়ি জমাল। কিছু দিন খবর রাখল, তারপর আর কোনো খবর নেই। মন খারাপ করো না তো। চলো যাই পাশের ঘরে ফুলজান বুবুর গীত শুনি। ফুলজান বুবু ভালো গীত গাইতে পারে। গীত শুনলে মনটা ভালো লাগবে।
মনটা কেমন আনচান করছে। এখানে বসে আমি ছেলেটার খবর নেই কিভাবে বলো তো বুবু? মন যে মানছে না। তুমি যাও বুবু, ফুলজান বুবুর গীত শোনো। আমি বরং দু-রাকাত নামাজ পড়ি আল্লাহর কাছেই বলিÑ তিনি যেন আমার ছেলেটাকে ভালো রাখেন।
ফুলজান বিবি গান গাইছে। সবাই তার চারিদিকে গোল হয়ে বসে খুব মন দিয়ে গান শুনছে। ওখানেই একজন পানের বাটা নিয়ে বসেছে। কেউ কেউ পান খাচ্ছে। কেউ গানের কথা শুনে চোখের পানি ফেলছে।
এই ফুলজান বিবির মনেও অনেক ব্যথা। অনেক কষ্ট। অল্প বয়সেই স্বামী মারা যায়। খুব কষ্ট করে একমাত্র ছেলে বসিরকে লালনপালন করেন। লেখাপড়া শেখান। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মা-ছেলে দু’জনের কোনো রকমে চলে যায়।
পড়াশোনা শেষ না করতেই ছেলে এক বড় লোকের মেয়ের প্রেমে পড়ে। তখন থেকেই মায়ের প্রতি অবহেলা। সে যে এক গরিব-দুঃখী মায়ের ছেলে এ কথা মানতে ইচ্ছে করত না তার। প্রতি মুহূর্তে মাকে ছোট করে কথা বলত সে। লেখাপড়া শেষ করে সেই বড় লোকের মেয়েকেই বিয়ে করে। ব্যবসায়ী লোকমান সাহেবের একমাত্র মেয়ের জামাই হিসেবে তার বিশাল ব্যবসা দেখাশোনা করার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
বিয়ের পরে বসির সম্পূর্ণভাবে শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়। মাসে মাসে মায়ের জন্য টাকা পাঠাত কিন্তু দেখা করত না। একদিন বৃদ্ধাশ্রমের মালিক বোরহান সাহেব ফুলজান বিবির বস্তিতে গরিব-দুঃখীদের জন্য খাবার বিলায়। তখন ফুলজান বিবি জানতে পারে বোরহান সাহেবের দুটি বৃদ্ধাশ্রম আছে। সেখানে দুস্থ বৃদ্ধ মানুষের জন্য বিনা খরচে থাকা, খাওয়া, পরা এবং চিকিৎসারও ব্যবস্থা আছে।
ফুলজান বিবি ছেলের পাঠানো টাকা ফেরত পাঠায় এবং বস্তির আরো দু’জন বয়স্ক মহিলাকে সাথে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি হয়। ফুলজান বিবি কখনো তার দুঃখের কথা বলে না। মাঝে মাঝে গান গায়। গল্প করতে পছন্দ করে। সে হাসি খুশি একজন দুঃখী মানুষ। এখানে সে সবার প্রিয় একজন।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো হালিমা বেগমের মনটা ভালো নেই। চুপচাপ বিছানার ওপর একা বসে আছে। এমন সময় রোমেলা এসে ঘরে ঢুকে একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলÑ কেমন আছেন খালারা? আজ আবার একটু বিরক্ত করব। সবাই নিজের বিছানায় বসুন। রোমেলা সবার প্রেসার মেপে একটি খাতায় লিখে রাখল। কারো কারো সুগার টেস্ট করল এবং খাতায় লিখে রাখল। রোমেলা প্রতি মাসে দু’বার আসে কিছু ওষুধও দিয়ে যায়। রোমেলা একজন এনজিও কর্মী।
রোমেলা চলে গেল। রোকেয়া বেগম হালিমা বেগমকে নিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের রহমত আলীর কাছে যায়। রহমত আলী তাদের পূর্ব পরিচিত। তারা দু’জন প্রায়ই রহমত আলীর সাথে দেখা করে। সুখ-দুঃখের কথা বলে। পুরনো দিনের কত গল্প করে। হালিমা বেগমের মনটা ভালো নেই বলে তার মন ভালো করার চেষ্টা করে রোকেয়া বেগম। তাই হালিমাকে নিয়ে সে রহমত আলীর কাছে আসে। রহমত আলী বারান্দায় একটি চেয়ারে বসেছিল। হালিমা বেগম আর রোকেয়া বেগমকে দেখে খুশি হয়ে বলে, আরে হালিমা বুবু, রোকেয়া বুবু কেমন আছ তোমরা? কতদিন পর দেখা। তোমরা এখন আর আস না। তা আজ কী মনে কইরা আইলা?
কথা বলতে বলতে সে দুটো মোড়া এগিয়ে দিয়েছে। রহমত আলী বড় আন্তরিকতার সাথে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের শরীরগতর ভালো আছে তো?
হালিমা বেগম চুপ করেই থাকে। তার কপালের ভাঁজে চিন্তার রেখা। রোকেয়া বেগম বলে, আছি ভাই, আল্লাহ তায়ালা যেমন রাখেন। এই বয়সে আর কতই ভালো থাকা যায়। তবে হালিমা বুবু সকাল থেকে ছেলের জন্য খুব অস্থির হয়ে আছে। কী করি বলো তো রহমত ভাই, ছেলে থাকে আমেরিকা। কিভাবে আমরা বুবুর ছেলের খবর জানতে পারব। তুমিতো পুরুষ মানুষ ভাই, একটা ব্যবস্থা করতে পারবা না?
রহমত আলী একটু চিন্তা করে বলে, আচ্ছা তোমাদের কাছে টেলিফোন নম্বর আছে। আমি কথা বলার ব্যবস্থা করি।
টেলিফোন নাম্বার থাকলে তো চিন্তাই ছিল না। একক্ষণ আমরাই খবর নিতে পারতাম।
রহমত আলী হালিমা বেগমকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে, কিভাবে শুরু করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে একটু কেসে গলাটা পরিষ্কার করে ধীরে সুস্থে বলল, হালিমা বুবু, তুমি ছোট মানুষ নও। আমরা তোমাকে কী বুঝাব? রাতে কী স্বপ্নে দেখেছ, তাই নিয়ে চিন্তা করে মাথা খারাপ করছ। আল্লাহ তোমার ছেলেকে নিশ্চয়ই ভালো রেখেছেন। অযথা চিন্তা করো না।
তবুও কত সময় মন আনচান করে ওঠে। মনে পড়ে যায় কত কথা। ছোট বেলার কথা। আমার মায়ের কথা। জানো হালিমা বুবু, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মা যে আমাকে কত ভালোবাসত। মনে হতো আমার মায়ের মতো করে কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। ছোটবেলা আমার খুব মাছ ধরার নেশা ছিল। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করতাম। স্কুল থেকে ফিরেই মায়ের আড়ালে চুপিচুপি মাছ ধরার জাল বর্শি নিয়ে কোন ফাঁকে বেরিয়ে যেতাম, মা টেরও পেত না। যখন বেলা গড়িয়ে যেত মা তখন উদ্বিগ্ন চোখে রাস্তার দিকে তাকাত। আমার জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠত। হঠাৎ কী মনে করে ঘরে গিয়ে দেখত মাছ ধরার সরঞ্জামগুলো আছে কিনা। ওগুলো খুঁজে না পেয়ে বলত, ওরে দুষ্ট কখন মাছ ধরতে গেছিস আমি টেরও পাইনি। আজ বাড়ি ফিরে আয় কঞ্চির বাড়ি একটিও মাটিতে পড়বে না।
মা রাগি রাগি চোখ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকত। তারপর হাত থেকে ঝুড়িটা নিয়ে বলত, তোর খাওয়া গোছল নেই? সেই কখন থেকে ভাত বেড়ে বসে আছি। দুষ্ট ছেলে আমার কোনো কথা শোনে না।
বাবা এসে বলছে, খোকার মা, এত মাছ কোথায় পেলে, আমি তো এ মাছ আনিনি বাজার থেকে।
কেন, তুমি জান না খোকা যে সুযোগ পেলেই মাছ ধরতে যায়। এই দেখ না আমার খোকা কত সুন্দর মাছ ধরে এনেছে।
বাবা তখন মুখটিপে হাসত। আর আমার খুব ভালো লাগত। আমি খুব আনন্দ পেতাম।
পড়াশোনা করতাম আর ইচ্ছে মতো খেলাধুলাও করতাম। বাবার সাথে মাঠে কাজও করতাম। বুবু, সে দিনগুলো যে কত মধুর ছিল।
একদিন মা আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল, খোকার বাপ। আমাদের তো একটিই ছেলে। আল্লাহ তো আমাদের অনেক দিয়েছে আর আমরা তো ছেলেকে জজ ব্যারিস্টার বানাব না। এখন পড়ালেখা বাদ দিয়ে সংসারে মন দিতে হবে।
সেদিন মা-বাবার আনন্দ দেখে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। খুব রাগ হয়েছিল। যা হোক আমার পড়ালেখার যবনিকাপাত ঘটানো হলো।
কিছু দিনের মধ্যেই মহাধুমধামের মধ্য দিয়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। ঘরে এলো দশ-এগারো বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে। তার নাম বকুল। দেখতে খুব সুন্দর। মা বলত লক্ষ্মী মেয়ে।
বকুল আসার পর থেকে আমার লেখাপড়ার জন্য অতটা আফসোস হতো না। শুধু ভাবতাম, বকুল এসেছে ভালোই হয়েছে।
তবে লেখাপড়াটা চলতে থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো। কতবার বুঝোলাম লেখাপড়াটা আমি করতে চাই। মা-বাবা কিছুতেই বুঝতে চাইল না।
বকুল আমার ধারের কাছেও আসত না। মার কথায় বাধ্য হয়েই মাঝে মাঝে আমাকে ভাত বেড়ে দিত। চুপচাপ মুখে কোনো কথা নেই। আমিই জিজ্ঞেস করতাম, মা কোথায়?
সে সলজ্জ কণ্ঠে উত্তর দিত, সবজি বাগানে গেছে।
মা মাঝে মাঝে আমাদের দুজনকে একা রেখে দূরে কোথাও যেত। আমি তখন ওকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করলে ও কোনো কথার উত্তর দিত, আবার কোনো কথার উত্তর দিত না। চুপ করে থাকত। আমিও অযথা বেচারিকে বিরক্ত করতাম না।
একদিন সাঁঝের বেলায় বকুল খড়ের গাদা থেকে খর বের করে জমা করছিল। আমি মাঠ থেকে গরু নিয়ে ওখান দিয়েই ফিরছিলাম। হঠাৎ আমার মাথায় একটি দুষ্ট বুদ্ধি এলো। গরুগুলো জায়গায় রেখে ওকে ভয় দেখানোর জন্য কাছাকাছি একটা জায়গায় লুকিয়ে মুখ দিয়ে একটা গোঙানির মতো শব্দ করছিলাম। শব্দ শুনে বকুল এমন এক চিৎকার দিল, আমি তখন কী করব দিশে না পেয়ে ওর কাছে গিয়ে বললাম, কী হয়েছে? এই তো আমি আছি ভয় নেই।
বকুল তখন দ্রুত আমার কাছে এসে চোখ বন্ধ করে আমার বুকের মধ্যে লুকাল আর বলল, আমি ভয় পাচ্ছি।
আমি ওকে ধরে মার কাছে নিয়ে গেলাম। সেদিনের সেই ছোট্ট বকুল আমার কাছ থেকে দূরে থাকলেও তার বিপদের সময় আমার বুকেই আশ্রয় খুঁজেছিল। বড় আফসোস হয় বুবু, সেদিন যদি ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করতাম। কী এমন ক্ষতি হতো। ওতো আমার ধর্ম মতে বিয়ে করা বউ।
বকুল ধীরে ধীরে বড় হলো। ও খুব মোহনীয় সুন্দরী হয়ে উঠল। ওকে বাড়িতে রেখে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করত না। আমি ওকে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। তখন ও বুঝতে শিখেছিল। দুজনের ভালো লাগা আর ভালোবাসার সময় যেন ঘনিয়ে এসেছিল। অল্প সময়ে বকুল আমাকে যে সুখ দিয়েছিল সে সুখের ছোঁয়া আজো বুকে লেগে আছে। দুজনের সুখ আনন্দে মাখামাখি, ঠিক তখনই বাদল হলো। বাদলের জন্মের সময়ই সে চিরদিনের জন্য এই পৃথিবী থেকে চলে গেল বুবু।
বলতে বলতে রহমত আলীর দুগণ্ড বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। রহমত আবার বলতে শুরু করল, বকুলের ছেলেটাকে আমার মা-বাবা আমি আদর যতœ করে মানুষ করেছিলাম। আমাকে আমার পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন সবাই বিয়ে করতে বলেছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। আমার মনে বকুল ছাড়া আর কেউ জায়গা পায়নি।
এখন ছেলে আমার বড় ডাক্তার। ঢাকায় তার নিজস্ব বাড়ি। সে বাড়িতে এই রহমত আলীর জায়গা হয়নি বুবু। তাতে আমার কোনো কষ্ট নেই। বেশ আছি।
রহমতের গল্প শেষ হতেই খবর এলো হালিমা বেগমকে তার বাড়ির কেউ নিতে এসেছে। আমেরিকা থেকে তার ছেলের লাশ পাঠানো হয়েছে। সাথে বউ বাচ্চাও এসেছে। ছেলের মুখটা শেষ বারের মতো মাকে দেখানোর জন্য একজন আত্মীয় এসেছে তাকে নিতে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন