হাসিন জাহানের সঙ্গে আমার দেখা হলো দীর্ঘ প্রায় ১৮-১৯ বছর পরে। কলেজজীবনে এই সহপাঠিনীর প্রেমে পড়েছিলাম আমি। বাকি জীবনে আমি যে আর বিয়ে-সংসার করলাম না, অনেকের ধারণা প্রথম প্রেমের সেই ব্যর্থতাই এর কারণ। এ বিষয়ে আমি নিজে কিছুটা বিভ্রান্ত, তাদের সেই ধারণাই ঠিক, নাকি পরবর্তীকালে আমার কিছু বিবাহিত বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজনের দাম্পত্য জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখে এই সামাজিক সম্পর্কটির আদৌ
কোনো অর্থ আছে কি না—এই প্রশ্ন উদাসীন করে তুলেছিল আমাকে। অবশ্য হাসিন যদি আমার কাঁচা অথচ তরুণ ও তাজা আবেগের মূল্য দিত তাহলে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত জানি না।
কোনো অর্থ আছে কি না—এই প্রশ্ন উদাসীন করে তুলেছিল আমাকে। অবশ্য হাসিন যদি আমার কাঁচা অথচ তরুণ ও তাজা আবেগের মূল্য দিত তাহলে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত জানি না।
হাসিন ছিল অসাধারণ রূপসী, ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকার উপায় তার ছিল না, বরং ভিড়-কোলাহলের মধ্যেও মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে ওঠার মতো একটা দৈব-পক্ষপাত ছিল তার চেহারা ও দৈহিক সৌন্দর্যে। ফলে তার প্রণয়াকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা ছিল দুহাতের করে গুনে হিসাব করার চেয়ে বেশি। নিজের রূপ ও এর মোহবিস্তারী শক্তি সম্পর্কে বিলকুল ধারণা ছিল তার। চারপাশে মৌমাছির অবিরত গুঞ্জনে অতিষ্ঠ, কিন্তু সমঝদার এই মেয়েটি একবার আমাকে ঠাট্টা করে বলেছিল, কিছু কিছু মেয়ের জন্য সামাজিক বিধান শিথিল হওয়া উচিত। মহাভারতের দ্রৌপদীর মতো পঞ্চস্বামীর সংসার করার অধিকার দিলে তাদের প্রতি সুবিচার হতো।
সে রকম সুযোগ থাকলে দ্বিতীয় থেকে পঞ্চমজনের মধ্যে আমারও যেকোনো একটা স্থান হয়ে যেতে পারত বলে রসিকতা করেছিল। সন্দেহ নেই এই ‘করুণা’ আমাকে ব্যথিত ও অপমানিত করেছিল। তারপরও আমাদের সম্পর্ক কখনো তিক্ততার পর্যায়ে যায়নি, কারণ তার প্রত্যাখ্যানের মধ্যে যেন রূঢ়তার চেয়ে অসহায়ত্ব ছিল বেশি।
চারুকলা কলেজে আমার এই সহপাঠিনী একবার আমার একটি তৈলচিত্রের মডেল হতে রাজি হয়েছিল। ঘটনাচক্রে সেই ছবিটি বার্ষিক প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার পায়। ছবিতে সুন্দরী তরুণীর কপালে লাল টিপ এঁকে সেটা একটু থেবড়ে দিয়েছিলাম। হাসিন সন্দেহ করছিল সেখানে লাল রঙের পরিবর্তে আমি নিজের এক ফোঁটা রক্ত মিশিয়ে দিয়েছিলাম কি না। এমনকি ছবিতে নাক ঠেকিয়ে শুঁকে দেখেও সে বোঝার চেষ্টা করেছিল তাতে রক্তের গন্ধ আছে কি নেই। আমি অবশ্য কখনোই তার এই কৌতূহল নিবৃত্ত করিনি।
ছবিটি আঁকার কিংবা প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হওয়ার পর তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল এবং যেকোনো কারণেই হোক আমার মতো ‘প্রতিভাবান’কে যোগ্য সম্মান দিতে পারল না বলে অনুতাপ করত। আমি তাকে এ ব্যাপারে কোনো অস্বস্তিবোধ না করার অনুরোধ করে বলেছি, যখন এই প্রস্তাবটা আমি দিয়েছিলাম তখন ঘোর বর্ষা ছিল, বর্ষা মানব মনে একটা বিশেষ ধরনের প্রভাব ফেলে এবং সম্ভবত ‘অসময়ে কোকিল ডাকিয়াছিল’।
শুধু সুন্দর চেহারা ও দেহকান্তির জন্য আমি হাসিনের প্রেমে পড়েছিলাম তা নয়। স্বীকার করতে হবে তার পাকা ধানের মতো গায়ের রং, বড় দুটি টলমলে চোখ, কমলার কোয়ার মতো ফোলা দুটি ঠোঁট আর বাঁকা সিঁথির দুপ্রান্ত থেকে কোমর অব্দি নেমে আসা ঝরঝরে সোজা চুল দেখে যে কারোরই মনে একবার হাহাকারের বোধ জাগতে পারে। তার মসৃণ হাতের সরু ও সুচারু আঙুলগুলো দেখে মনে হবে পিয়ানোর রিড বা তানপুরার তার ছাড়া আর কোথাও এর স্পর্শ বেমানান।
তবে পরিচয়ের পর তার জমিয়ে কথা বলার ধরন আমাকে মুগ্ধ করেছিল বেশি। সে অদ্ভুত সব ঘটনা বিশ্বাস করত এবং অন্যদের বিশ্বাস করতে বলত। বন্ধুরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেসব ঘটনা শুনে বিভ্রান্ত হতো এবং নানা দোলাচলের মধ্যেও শেষ পর্যন্ত মেনে নিত।আমি বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু শুনতে পছন্দ করতাম, ভালো লাগত। যেমন একবার সে আমাকে গোপনে বলেছিল, তার যে অসাধারণ রূপ (নিজের এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে খুবই নিশ্চিত ছিল) তা মোটেই পারিবারিক জিনসূত্রে পাওয়া নয়। তার আপন বড় বোন ও মা-বাবা কিংবা বংশের কেউই দেখতে সুন্দর নয়। মাত্র সাত কি আট বছর বয়সে এই রহস্য তাকে জানিয়েছিল তার দাদি। তার মা দ্বিতীয়বার সন্তান প্রসব করার পর প্রায় কাকের ছানার মতো একটি শিশুর মুখ দেখে বিবমিষা হয়েছিল দাদির। একে তো ছেলে ও বউমার ঘরে পরপর দুটি কন্যাসন্তানের জন্ম তাঁকে বিমর্ষ করে দিয়েছিল, তদুপরি মেয়েটির এ রকম বদ্খত চেহারা-সুরত দেখে যারপরনাই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এ অবস্থায় কী করা যায়, আদৌ কিছু করা যায় কি না ভাবছিলেন দাদি এবং কাকতালীয়ভাবে কিছু একটা করার সুযোগ তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন।
হাসপাতালে পরীর মতো সুন্দরী এক সদ্যপ্রসবার কন্যার সঙ্গে কৌশলে অদলবদল করে ফেলেছিলেন নিজের ছেলে-বউয়ের সন্তানটি। তখন গভীর ঘুমে অচেতন ছিলেন দুই নারীই। একমাত্র সাক্ষী হাসপাতালের আয়াকে বড় অঙ্কের বকশিশ দিয়ে হাত করেছিলেন দাদি।
হাসপাতালে নানা রকম কাণ্ডকীর্তি হয় বলে শুনেছি, কিন্তু এ ঘটনা মোটেই বাস্তবসম্মত মনে হয়নি আমার। গাইনি ওয়ার্ডের ডাক্তার, নার্স সর্বোপরি অ্যাটেনডেন্টদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এমন একটি কাজ সেরে ফেলা মোটেই সম্ভব বলে মনে হয় না। তার ওপর এ রকম একটি ঘটনার কথা পরিবারে আর কারোর মুখে কখনো শোনা যায়নি, দাদি তাকেই বলল, যে কিনা নিজেই এই প্রতারণার অন্যতম শিকার—এটাও বিশ্বাস করার পক্ষে একটু কঠিনই। যাহোক বড় বোন শিরীন সুলতানার সঙ্গে কোনো মিল না রেখে এই দাদিই তার নাম রেখেছিলেন হাসিন জাহান।
হাসিন আমাকে বলেছিল, এখনো মায়ের বয়সী সুন্দরী নারী দেখলেই সে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের জন্মদাত্রীর খোঁজ করে। পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস হয়নি বটে, কিন্তু তার নিজের বিশ্বাসের কথা ভেবে, গভীর দীর্ঘশ্বাসের পর তার কষ্টের ছাপ পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সমবেদনা জানিয়েছিলাম সেদিন।
আমার ধারণা ছিল, এ ঘটনা গোপনে শুধু আমাকেই জানিয়েছিল হাসিন, কিন্তু পরে শুনেছি আমার বন্ধুরা অনেকেই হাসিনের জন্ম ও জন্মের অব্যবহিত পরের ঘটনা সম্পর্কে জানে। বিশ্বাস কে করেছে বা করেনি সেটা তাদের ব্যাপার, কিন্তু তারা শুনেছে হাসিনের মুখেই।
হাসিন জাহানকে নিয়ে নানা রসাল ও মুখরোচক কাহিনি চালু ছিল বন্ধু ও পরিচিত মহলে। লক্ষ করেছি আমাদের যেকোনো আড্ডায় বিভিন্ন বিষয় ঘুরে কোনো না কোনোভাবে একবার এই মেয়েটির প্রসঙ্গ উঠতই এবং তেমন কোনো জুতসই সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই ওর চারিত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতি বিষয়ে একমত হতো সবাই। আমি এ বিষয়ে মতামত দিতাম না, কারণ আমার মনে হয়েছে এটা সুন্দরীদের দুর্ভাগ্যের একটা দিক। এতে আছে কারও ঈর্ষা-পরশ্রীকাতরতা, কারওবা অপ্রাপ্তির বেদনা থেকে আঙুর ফলকে বিস্বাদ মনে হওয়ার গল্প।
হাসিন চলে যাওয়ার পর অন্তত আরও দুই নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম আমি। কিন্তু নির্দিষ্ট পরিণতিতে পৌঁছানোর আগেই শিথিল হয়ে পড়েছিল দুটি সম্পর্কই। তাদের ঘাটতি কিছু ছিল না, বরং বলা চলে একটি পুরুষের জীবনকে সুখী ও অর্থপূর্ণ করে তোলার যথেষ্ট সামর্থ্য ছিল দুটি মেয়েরই। কিন্তু যে ছবিটা আমি এঁকে ফেলেছিলাম একবার, সেই ছাঁচের মধ্যে ফেলে অন্য অবয়বকে সম্পূর্ণ করে তোলার চেষ্টার মধ্যেই মস্ত একটা ফাঁকি ছিল। মানুষ তো একটি অবয়ব শুধু নয়, প্রত্যেকের পৃথক অভিব্যক্তি, আলাদা ভাষা আছে। একসময় তারাও হয়তো লক্ষ করছিল আমার দৃষ্টিতে আছে অন্য অনুসন্ধান, অন্য একটি ছায়া খুঁজে চলেছি আমি। একজীবনে অন্য ছায়াটির সন্ধান করেই হয়তো দিব্যি সুখী দাম্পত্য চালিয়ে নিতে পারছে অনেকেই, আমি পারলাম না।
একবার এমনকি পারিবারিক একটি উদ্যোগেও সম্মতি দিয়েছিলাম। কিন্তু কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার পর প্রায় শেষ মুহূর্তে নিকটজনদের রীতিমতো বিব্রত ও বিরক্ত করে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেছিলাম।
‘এত দিন পরে এলে, কেন এলে?’ আমি হাসি ও কৌতুকের ছলে জিজ্ঞেস করলাম হাসিনকে।
‘আজ সে বিশ সাল প্যাহলে, তুমি আমাকে...।’ বাক্য অসমাপ্ত রেখে হাসল সে।
আমার নবীন যৌবনের আকুলতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছে হাসিন। তাতে অবশ্য এতকাল পর আমার আহত বা বিব্রত হওয়ার কিছুই তেমন নেই। বরং তার বিখ্যাত হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো জীবনের এতগুলো হেমন্তকাল পেরিয়ে এসেও হাসিন জাহান প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে অনেকটাই উপেক্ষা করতে সমর্থ হয়েছে। আগের তীব্রতার পরিবর্তে শান্ত স্নিগ্ধ একটা বাড়তি দীপ্তি যুক্ত হয়েছে চেহারায়। বাড়তি যেটুকু পরিবর্তন লক্ষ করলাম, দাঁত বের করে হাসলে এখন দুচোখের পাশে ত্বকে পাখির পায়ের আঁচড়ের মতো দু-একটি রেখা ফুটে ওঠে। দীর্ঘকালের ব্যবধানে এই সামান্য পরিবর্তন মোটেই আলাদা করে উল্লেখ করার মতো নয়।
কালোর ওপর জরির কাজ করা পাড়, মসলিনের সাদা একটি শাড়ি পরেছে, কালো ব্লাউজ। এখনো জাঁকিয়ে শীত পড়েনি, তবু কালো একটি শাল জড়িয়ে এসেছিল। ঘরে ঢুকেই সেটা চেয়ারের হাতলের ওপর ঝুলিয়ে রেখেছে।
হাসিনের বিয়ে হয়েছিল এক চিকিৎসকের সঙ্গে। নাটকীয়তা ছিল সেখানেও। পাত্রপক্ষের সামনে ছোট বোনকে দেখিয়ে বড় বোন শিরীন সুলতানার বিয়ে দেওয়ার একটি অপচেষ্টা করেছিল তার পরিবার। শেষ মুহূর্তে চিকিৎসক পাত্র ও তার আত্মীয়স্বজন এই প্রতারণায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিয়ের আসর থেকেই পাত্রকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে ছোট বোন হাসিনকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল পরিবার।
প্রায় বিনা আপত্তিতে সেই চিকিৎসককে বিয়ে করে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে গিয়েছিল হাসিন। এই মেয়ের মাথায় সামান্য গন্ডগোল আছে—এ সন্দেহ প্রথম থেকেই ছিল। বিয়ের ঘটনাটি শোনার পর থেকে তার পুরো পরিবারকেই একই রোগে আক্রান্ত মনে হয়েছে আমার।
বিয়ের পর মোটামুটি সুখেই সংসার করেছিল বলে জানাল হাসিন। অভাব শুধু একটিই, সন্তানাদি ছিল না। চিকিৎসক স্বামী কখনোই এর জন্য হাসিনকে দায়ী করেনি এবং অকপটে জানিয়েছিল সমস্যাটি তারই। শিরীন সুলতানার অভিশাপেই এ রকমটি হয়েছে বলে বিশ্বাস করত হাসিনের স্বামী মনসুর এবং এও বলত তার জীবন দীর্ঘায়িত হবে না। এটিও ঘটবে শিরীনের অচরিতার্থ আকাঙ্ক্ষার দীর্ঘশ্বাসের কারণেই। নিজের এই ধারণা সত্য প্রমাণ করে বছর তিনেক আগে ডা. মনসুর মারা গেছে। মৃত্যুর আগে উইল করে তার শরীরটি দান করে গিয়েছিল মেডিকেল কলেজে। এতে আপত্তি ছিল হাসিনের। কিন্তু নিজের প্রাণহীন দেহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রদের কাজে ব্যবহৃত হবে, এ রকম মহৎ ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মনসুর তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল।
আমি হাসিনের প্রেমে পড়েছিলাম তার জমিয়ে কথা বলার ধরনের জন্য। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোটানার মধ্যে ফেলে দিত সে আমাকে এবং সম্ভবত আমি এ রকম একাকার হয়ে যাওয়া অনুভূতি উপভোগ করতাম। এত বছর পর আমি আবার সেই বিভ্রান্ত অবস্থার মুখোমুখি হলাম।
‘আমার এই আস্তানাটি খুঁজে বের করলে কী করে?’ কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর আমি জানতে চাইলাম তার কাছে।
‘খুব সোজা। তুমি আর্ট কলেজের শিক্ষক, সেখানে গেলে কেউ না কেউ তো শিক্ষকের বাড়িটি চিনিয়ে দেবে।’
কথা ঠিক। আমি দেবপাহাড় এলাকায় একটি বাড়ির চিলেকোঠায় একা থাকি। কলেজে যেটুকু সময় কাটে, তার বাইরে খুব একটা কোথাও যাই না। এই অগোছালো একচিলতে ঘরেই শুয়ে বসে, বই পড়ে, ছবি এঁকে আমার দিন কেটে যায়। আমার মধ্যে বড় শিল্পী হওয়ার সম্ভাবনা দেখতেন অনেকেই। সেসব কিছুই হয়নি, এখন আমি শুধুই চারুকলা কলেজের একজন প্রবীণ শিক্ষক। বলা চলে অনাদরে অবহেলায় এক কোণে পড়ে থাকা একজন মানুষ। ছাত্রছাত্রী বা তরুণ সহকর্মীরা কেউ কেউ বাসায় আসতে চাইলে আমি এড়িয়ে চলি। কিন্তু কলেজের অফিসের পিয়ন, কেরানিদের নানা কাজে এ বাসায় আসতে হয়েছে। তাদের কেউ হাসিনকে বাসা চিনিয়ে দিতেই পারে।
আবার প্রশ্ন করলাম, ‘কেন এলে?’
‘তুমি খুশি হওনি আমাকে দেখে?’
নিশ্চয়ই হয়েছি। হাসিনের উপস্থিতি এখনো তার চারপাশকে সচকিত করতে পারে, আনন্দময় করে তুলতে পারে। বললাম, ‘হয়েছি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছি।’
এবার কাজের কথায় আসতে চাইছে বোঝা গেল হাসিনের কথায়। বলল, ‘তুমি একটি নবজাতককে দত্তক নিতে চেয়েছ?’
বিস্মিত হই আমি। কিছুদিন আগে সংবাদপত্রের পাতায় একটি নির্মম সংবাদ দেখেছিলাম। ডাস্টবিন থেকে একটি ফুটফুটে কন্যাশিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। আশপাশের লোকজন সদ্যোজাত শিশুটিকে মেডিকেল কলেজে দিয়ে এসেছিল। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা শিশুকন্যাটিকে পরিচর্যা করে সুস্থ করেছেন এবং ডাক্তার ও নার্সদের স্নেহে বেশ কটা দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন এই প্রশ্নটি সামনে এসেছে, মেয়েটির আশ্রয় মিলবে কোথায়? আমি সংসার-বিরাগী মানুষ। সংসারের স্বপ্নই দেখিনি, অপত্য স্নেহকাতরতা আমার ওপর ভর করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কী অজ্ঞাত কারণে একজন নার্সের কোলে হাসিমুখের শিশুটির ছবি সংবাদপত্রে দেখে অদ্ভুত খেয়াল জাগল আমার মনে। একটি মানবশিশুকে বড় করে তোলার অভিজ্ঞতা লাভ করার বাসনা হলো, এ বিষয়ে আমার এক হাজার একটি অসুবিধার কথা জেনেও এই বাসনা নিবৃত্ত করতে পারলাম না।
‘তোমারটি ছাড়া আরও পাঁচটি আবেদনপত্র জমা পড়েছে তুমি জানো?’
‘না।’
‘সুতরাং তুমি পাচ্ছ না। এ বিষয়ে সাত দিন পর আদালতে শুনানি হবে। আদালত নিশ্চয় একজন অবিবাহিত নিঃসঙ্গ মানুষকে একটি নবজাতক সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব দেবেন না।’
এ কথার যুক্তি আছে। শিশুটিকে আমার কাছে না দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাতে কী আর হবে, জীবনে এ রকম অনেক অপ্রাপ্তির অভিজ্ঞতা আমার আছে। কিন্তু শিশুটির বিষয়ে হাসিনের এত কৌতূহল কেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আমার কাছে এসেইবা এ বিষয়ে কথা বলার কী কারণ থাকতে পারে!
হাসিন বলল, ‘মেয়েটিকে দত্তক নেওয়ার জন্য আমিও আবেদন করেছি। কিন্তু সমস্যা আছে। আমিও একা বিধবা মহিলা, আমাকে দেবে বলে মনে হয় না। আদালত বরং এই শিশুর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য একটি নিঃসন্তান দম্পতিকেই উপযুক্ত মনে করবেন।’
‘তাহলে তো কিছু করার নেই।’ হতাশ কণ্ঠে বললাম আমি।
‘আছে। করার আছে। খুব সহজেই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। সে জন্যই তো তোমার কাছে এলাম।’
‘আমি কী করতে পারি?’
‘তেমন কিছুই না, তুমি জাস্ট আমাকে বিয়ে করে ফেলো। আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে মেয়েটিকে দত্তক চাইব।’
আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি হাসিন জাহানের দিকে। চিরকাল এই নারীর হেঁয়ালি-তামাশা আমাকে বিভ্রান্ত করেছে। এবারও সে রকম অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
‘আমাকে বিয়ে করতে আপত্তি আছে তোমার? আমি বুড়ি হয়েছি বলে?...তুমিও তো এখন আর সেই যুবকটি নেই, বুড়োবুড়ির সংসার হবে। কী সমস্যা?’
হাসিন জাহানের এই এক সুবিধা। পৃথিবীর কোনো সমস্যাকেই সে গুরুতর ভাবতে অভ্যস্ত নয়।
অদ্ভুত এক ধন্দের মধ্য থেকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমিইবা এত ডেসপারেটলি মেয়েটাকে চাইছ কেন?’
এবার আমাকে আপাদমস্তক কাঁপিয়ে দিয়ে হাসিন বলল, ‘কারণ মেয়েটি আমার।’
‘মানে?’
‘মানে মেয়েটিকে জন্ম দিয়েছি আমি।’
আমার বিস্মিত হওয়ার শক্তিও যখন প্রায় নিঃশেষ, তখন নতুন একটি গল্পের অবতারণা করল হাসিন। তার মৃত স্বামী মনসুর প্রায় প্রতিদিনই স্বপ্নে দেখা দিত তাকে। দিনের আর কোনো সময়ে নয়, রাতে একাকী শয্যাশায়ী হলেই তার পাশে আসত মনসুর। প্রথম দিকে ভয় পেত, কিন্তু চিৎকার করে ওঠার শক্তি পেত না। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে একা বিছানায় আবিষ্কার করে ব্যাপারটা তার দুর্বল মনের কল্পনা বলে ধরে নিত এবং ভাবত পরের রাতে ও রকম আর ঘটবে না। কিন্তু পরের রাতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটত। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। মৃত স্বামীর সঙ্গেই রাত্রিযাপন করতে শুরু করেছিল। নিয়মানুযায়ী মৃতদেহের সৎকার করা হয়নি বলেই এমনটা হতে পারে বলে ধরে নিয়েছিল সে। একসময় বুঝতে পারল ব্যাপারটা শুধুই স্বপ্নে বাঁধা থাকছে না, কেননা মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে হাতে স্পর্শ করে অনুভব করেছে মনসুরের অস্তিত্ব। স্বপ্নেই একদিন তার সঙ্গম প্রার্থনা করেছে মনসুর, বলেছে, এবার সন্তান হবে, তার যাবতীয় শারীরিক ত্রুটি সেরে গেছে।
‘তারপর মৃত স্বামীর সঙ্গে তোমার দৈহিক মিলনের পর তুমি গর্ভবতী হলে এবং যথাসময়ে তোমার একটি কন্যাসন্তান হলো, তাই তো?’ প্রচণ্ড অসহিষ্ণুতা ও রাগ প্রকাশ পাচ্ছিল আমার কণ্ঠে।
কিন্তু একটুও উত্তেজিত না হয়ে শান্ত ও দৃঢ় গলায় সে বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। গর্ভধারণের পর আর কখনো আমাকে দেখা দেয়নি মনসুর।’
‘বিশ্বাস করি না’—চিৎকার করে উঠি আমি। ‘তোমার এসব গালগল্প অনেক শুনেছি, দয়া করে এই আজগুবি গল্প বিশ্বাস করতে বোলো না আমাকে।’
কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেল হাসিন। বেদনার্ত মুখে তাকাল আমার দিকে। বলল, ‘জানি, কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু এটাই সত্য। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর স্কুলের চাকরি ছেড়েছি আমি, ঢাকা ছেড়ে এসেছি। বাপের বাড়িতে এসে আত্মগোপন করে ছিলাম, যাতে আমার শরীরের পরিবর্তন কারও চোখে না পড়ে। আমার বাবা তো বেঁচে নেই, মায়ের অনেক গঞ্জনা সহ্য করেও ভ্রূণ নষ্ট করিনি।’
‘বাচ্চাটা ডাস্টবিনে এল কী করে?’
‘আমিই রেখেছি। এই সন্তান নিয়ে অকূল সমুদ্রে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার মা সন্তানসহ আমাকে বাড়িতে আশ্রয় দিতে রাজি ছিলেন না, তাঁরও তো আত্মীয়স্বজন, সমাজ বলে কিছু একটা আছে! নিজের বাচ্চা পরিচয় দেওয়ার তো উপায় ছিল না। ওর জন্মের দুদিন পর ক্লিনিক থেকে ফিরেই এক বিকেলে মেডিকেল কলেজের কাছে একটি নির্জন এলাকায় কাপড় মুড়িয়ে বাচ্চাটাকে ডাস্টবিনে রেখে এসেছিলাম। তবে দূর থেকে লক্ষ রাখছিলাম। যা ভেবেছিলাম, একসময় পথচলতি মানুষের কানে গেল শিশুর কান্না। একজন-দুজন করে বিস্মিত লোকের ভিড় বাড়তে থাকল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হই-হট্টগোল বেধে গেল। ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলাম আমিও, কেউ সন্দেহ করেনি। এক তরুণকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শটাও আমিই দিয়েছিলাম।’
হা ঈশ্বর, স্বপ্ন-সঙ্গমে মৃত স্বামীর ঔরসে সন্তান লাভের ঘটনাও বিশ্বাস করতে হবে আমাকে!
নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছিলাম। কারণ এই মহিলা আমাকেই পাগলে পরিণত করার চেষ্টা করছে কি না বুঝতে পারছি না কিছুতেই। বিকেলটা তখন অন্ধকারের দিকে গড়াচ্ছে, এই শীতের মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছি আমি। একবার উঠে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলাম ঘরে, পাখাটাও ছাড়তে হলো।
হঠাৎ একটা যুক্তির ইশারা পেয়ে দীর্ঘ নীরবতা ভাঙলাম আমি, আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে জানতে চাইলাম, ‘পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া বয়সে কেউ গর্ভধারণ করতে পারে? মা হতে পারে হাসিন?’
ম্লান হাসল সে। উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের সঙ্গে লাগানো দীর্ঘ জানালাটি বন্ধ করে ফিরে এল নিজের জায়গায়। তারপর আমাকে দারুণ অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়ে হঠাৎ বুকের কাপড় সরিয়ে ব্লাউজ ও অন্তর্বাস খুলে ফেলল। ফরসা, ভরাট, সুন্দর স্তন।
এই বাসাটাতে দীর্ঘকাল একা থাকি আমি। বহুতল ভবনটির বাসিন্দাদের কাছে আমার একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি আছে। এখন একটি মহিলা আমার ঘরে উদোম গায়ে বসে আছে—এই দৃশ্য ছাদে পায়চারিরত কেউ যদি উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে ফেলে তাহলে কী হবে? তা ছাড়া দীর্ঘকাল নারীসঙ্গবঞ্চিত মানুষ আমি, অস্বীকার করি কী করে এমন শারীরিক সৌন্দর্য বিহ্বল করে তুলেছে আমাকে!
কিন্তু হাসিন আগের মতোই নির্বিকার ও শান্ত। বিমূঢ় অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতেই বোধ করি হাত তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করল আমার, তারপর নিজের ডান হাত চেপে ধরল বাঁ স্তনের ওপর। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল সাদা তরল।
‘এরপরও আমার মাতৃত্বকে অস্বীকার করবে?’ হাহাকারের মতো শোনাল তার গলা।
ধীরে আবৃত করল বক্ষদেশ, শাড়ির আঁচলটা বুকের ওপর টেনে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছাদসংলগ্ন আমার চিলেকোঠার জানালাটি খুলে দিয়ে এসে আবার বসল মুখোমুখি। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ঘরে ঢোকার পর কিছুটা স্বাভাবিক বোধ করছি তখন। এটুকু স্বস্তির অনুভব থেকে কথা বলার শক্তিও ফিরে পেলাম যেন।
‘যা-ই বলো, মৃত স্বামীর সঙ্গে...ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারছি না।’ প্রায় দিশেহারা কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম আমি।
এবার এগিয়ে এসে দুহাত চেপে ধরল আমার, অনুনয়ের সুরে বলল, ‘ওটা বিশ্বাস না-ই করলে, না হয় তোমার মনের মতো একটা ব্যাভিচার বা পাপের দায় চাপিয়ে দাও আমার ওপর। তবু আমাকে বিয়ে করো, তুমি তো ভালোবেসেছিলে আমাকে...।’
আমি হাসিন জাহানের দিকে তাকিয়ে থাকি। যে দুর্লভকে না পেয়ে ভরা বসন্তের দিনগুলোতে একটি নিষ্পত্র বৃক্ষের জীবন কাটল আমার, আজ এতকাল পর নিজেই সে যখন দুহাত পেতে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার শক্তি কি আমার আছে?
———
সচিত্রকরণ : সমরজিৎ রায় চৌধুরী