পুরীর সমুদ্রের ধারে ডাঃ ভদ্রের সঙ্গে দেখা। তিনি ও আমি পাশাপাশি বসে ছিলাম ক’দিন বালির ওপরে, কিন্তু আলাপ হল সামান্য সূত্রে, একদিন আম কিনতে গিয়ে বাজারে। টাকায় দিশি আম বিক্রি হচ্ছিল আটাশটা, আমি বলছিলাম পঁয়ত্ৰিশটা। এই নিয়ে আমওয়ালার সঙ্গে তর্ক বেধে গেল। ডাঃ ভদ্র এসে তর্কের মীমাংসা করিয়ে দিয়ে একটাকায় বত্ৰিশটা আমের পথ খোলসা করে দিলেন—সুতরাং ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ না হয়ে পারল না।
ডাঃ ভদ্র দেখতুম বেশ ঈশ্বর ভক্ত ও ধাৰ্মিক লোক। ফাঁক পেলেই ঈশ্বরের কথা বলতে আরম্ভ করেন। পুরীতে যত মঠ মন্দির ছিল, আমাকে সব দেখিয়ে নিয়ে বেড়ালেন প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে। বলেন—ওই আমার বাতিক—
একদিন আমাকে একটি গল্প বললেন সমুদ্রের বালির ওপর বসে। ভদ্রলোকের নাম হারাধন ভদ্র, নিবাস হুগলী জেলার কী গ্রামে, সেখানেই ডাক্তারি করেন, পসার মন্দ নয়। বাড়ির অবস্থা বেশ ভাল, অনেক ধান হয় বছরে। গোরু বাছুর এক গোয়াল। ভালভাবেই খাওয়াপরা চলে যায় দেশে।
তাঁর এক বাতিক পরের উপকার করা। নিজের বৃহৎ পরিবার, চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, দুটি বেকার ছোট ভাই, তা সত্ত্বেও তিনি যখন যার দুঃখের কথা শোনেন, পকেটের পয়সা বের না করে পারেন না। পকেট খালি করে দিয়ে তবে তাঁর তৃপ্তি। কত গরিব কুমারী মেয়ের পাত্ৰ জোগাড় করে দিয়েছেন নিজে অর্থব্যয় করে, কত দুঃস্থ লোককে সাহায্য করেছেন।
এসব পরোপকারের গল্প তিনি আমাকে করেছেন। বেশ সরল লোক।
সমুদ্রধারের ঝাউবনের মধ্যে একটি মঠ আছে। শান্ত, জনবিরল মঠটি। কী একটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের। কিন্তু সম্প্রদায়ের হাতে বোধহয় তেমন টাকাকড়ি নেই, বেশি লোকজন থাকে না। এই বার থেকে তার নিজের কথাতেই বলি।
বড় ভাল লাগত মঠটি। বিকেলবেলা ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে হু হু করে সমুদ্রের হাওয়া আসত। হাওয়ার সঙ্গে মিশে আছে লবণাক্ত সমুদ্রের গন্ধ। বেশ ছায়া পড়ত মঠের আঙিনায়। মঠের বাগানে জুঁই, বেল, কৃষ্ণকলি ফুটত। আমি বিকেলের দিকেই সেখানে যেতাম বেশিরভাগ। দু-তিনটি বৈষ্ণব সাধু সে সময় বাসন-কোসন মাজত, ঘর রোয়াক ধূত, মঠের অন্যান্য কাজকর্ম করত। আমাকে একটা কাঁসার ঘটিতে চা নিয়ে এসে দিত, ফলমূল বাতাসা প্ৰসাদ দিত। বেশ কাটত সন্ধ্যাবেলাটা। প্রায়ই যাই সেখানে।
এদের মঠের একটা ছোট্ট ঘরে একদিন একটি শ্ৰীকৃষ্ণমূর্তি দেখি। রাধা নেই, শুধু কৃষ্ণমূর্তি, কালো পাথরের। এমন সুন্দর মুখশ্ৰী, এমন শান্ত চোখদুটি, অনেক কৃষ্ণমূর্তি দেখেছি, কিন্তু এ মূর্তিটি যেন সবচেয়ে পৃথক। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম মূর্তিটা কেমন যে ভাল লাগল। সেই থেকে রোজ একবার করে যেতাম মূর্তিটি দেখতে। তেমন করে পুজো-আচ্চা হয় না বিগ্রহটির। এক এক দিন একরাশ বেলফুল তুলে নিয়ে সাজিয়ে দিতাম বেদীতে। টাটকা-তোলা বেলফুলের সুগন্ধ ভুরভুর করত মন্দিরে।
রোজ দেখে দেখে মনে হল এই কৃষ্ণঠাকুরটি এমন চমৎকার দেখতে, কেমন সুন্দর বালকের মতো অভিমানস্ফুরিত ওষ্ঠাধর, শান্ত, সুকুমার মুখমণ্ডল, ঈষৎ বঙ্কিম দৃষ্টিভঙ্গি—অথচ পুরী শহরের বহু মঠ-মন্দিরের বিগ্রহের মতো ইনি বহুজনপূজিত, বহুজনদৃষ্ট বা বহুজনকাম্য নন—নিতান্ত অবহেলিত, এবং উপেক্ষিত। কেউ একে জানে না, এখানে কেউ আসেও না, মঠের অন্নদাস সেবকেরা হেলায় শ্রদ্ধায় দুটো ফুল ফেলে দিতে হয় তাই দেয়। রোজ রোজ দেখে কেমন একটা মায়া জন্মাল আমার এই বেচারি বিগ্রহটির ওপর। ওই জন্যেই নিজে হাতে বেলফুল তুলে নিয়ে গিয়ে বেদী সাজিয়ে দিতাম।
পুরী থেকে চলে এলাম মাসখানেক পরে।
কর্মস্থলে ফিরে এসেও সদাসর্বদা সেই বিগ্রহটির মুখশ্ৰী আমার মন জুড়ে বসে রইল। কেমন একটা মায়া, যেন আপনার কোনও লোককে অসহায় ও অনাদৃত অবস্থায় ফেলে এসেচি কত দূরে। এমন মনের ভাব আমার কখনও হয় না, এর আগে হয়নি কোনও কারণে। নিজের মনের ভাবে নিজেই বিস্মিত হই। আবার ছুটে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় একবারটি, কিন্তু হুগলি জেলার একটি অখ্যাত পল্লিগ্রাম থেকে পুরী অনেক দূর, পয়সার সে সচ্ছলতার অভাব, যার বলে বছরে দু’বার করে পুরী যাওয়া চলে। এই ব্যাপারের বছরখানেক পরে আবার চৈত্র বৈশাখ মাস এল।
মন অমনি বিষম চঞ্চল হয়ে উঠল দূরের এক নীল সমুদ্র, ঝাউবন ও পোলাং গাছের ছায়াবিরল কুঞ্জের জন্যে। সেই সমুদ্রসৈকত, সেই জ্যোৎস্না, সেই প্রাচীন মন্দিরের সারি, পুরনো দরজার দুদিকে স্পৰ্দ্ধিত ভঙ্গি ঝম্প সিংহের দল সর্বোপরি সেই ক্ষুদ্র বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মঠটিতে অনাদৃত সেই বালকবিগ্ৰহ মূর্তি—এদের আকর্ষণ প্রবল হয়ে উঠল মনের মধ্যে। আমনি কিছু টাকা জোগাড় করে পুরী এসে পড়লাম।
মালতী পাটপুর স্টেশন যখন ছাড়াল তখন আমার মন উড়ে চলেচে সেই বৈষ্ণবমঠের বিগ্রহের কাছে। কতক্ষণে পুরী স্টেশনে ট্রেন আসবে?
পুরীতে পদার্পণ করেই রিকশা নিয়ে ছুটিলাম ধৰ্মশালার দিকে। বেলা তখনও সামান্য আছে, জিনিসপত্র ধর্মশালার ঘরে রেখে একটা দোকানে চা খেয়ে নিলাম, তারপরেই সেই মঠে গিয়ে হাজির।
সত্যি, একটুও বাড়িয়ে বলচিনে, কি আনন্দ যে হল ওকে দেখে।
ও—ও যেন আমাকে দেখে অত্যন্ত খুশির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। যেন ওর স্ফূরিত অধরে অভিমানের প্রকট চিহ্ন, দৃষ্টিতে প্রচ্ছন্ন অভিমান; যেন ও বলতে চাইচে এতদিন বুঝি আসতে নেই?
আসব কী করে? টাকা ছিল? তুমি বুঝি জানো না আমার টাকা ছিল কি না?
বেশ বাবা।
কত রাত হয়েচে খেয়াল নেই, মঠের সেবাইত চাকর এসে জানালে মঠের দোর বন্ধ করার সময় হয়েচে।
সেবার দিনচারেক পুরীতে ছিলাম।
আবার সেই ফুল তোলা, আবার সেই বেদী সাজানো। কোনও দিন কামাই যেত না। ভালবাসার বৃদ্ধি, এমনতর বৃদ্ধি যে পুরী ছেড়ে যাবার সময় দস্তুরমতে কষ্ট হল সেবার।
যাহোক, বাড়ি তো চলে গেলাম। হুগলি জেলার আরামবাগ সাবডিভিশনে আমার বাড়ি, রেলস্টেশন থেকে অনেক দূরে। যেমন মশা, তেমনি ম্যালেরিয়া। এত রোগী বেড়ে গেল সেবার যে বাড়িতে নাওয়া-খাওয়ার সময় পাই না, দুটাকা আয়ও হতে লাগল।
শ্রাবণ মাসের দিন। সারা দুপুর মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। আমি গোরুর গাড়ি করে বাড়ি ফিরচি তিন মাইল দূরের একটা গ্রাম থেকে। কেদেটির খাল জলে টইটম্বুর হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেচে। গাড়োয়ান বললে, বাবু খাল পার হব? জল বডড বেড়েচে—
আমি বললেম—কিছু হবে না, চলো। কতটুকু জল বেড়েচে আর—
যাবার সময় এই খালের জলে নেমে গাড়ি পার হয়েচে সুতরাং আমার ভয় কিছুই ছিল না। কিন্তু জলে নেমে ঠিক যখন খালের মাঝখানে আমরা এসেচি, তখন হঠাৎ গাড়োয়ান চেচিয়ে বলে উঠল—জলের তোড় বড্ড বেশি—ছইয়ের দড়ি খুলে দ্যাও, তাড়াতাড়ি ছইয়ের দড়ি খেলো—ও ডাক্তার বাবু শিগগির! কী হচ্ছে বা কী ঘটছে ভাল করে বোঝবার আগেই ছইসুদ্ধ গাড়ি উলটে গেল জলের তলায়। আমি সাঁতার জানি বটে, কিন্তু উপুড় হওয়া ছইয়ের মধ্যে এমন করে হাত-পা আটকে গেল, মাথা ঠেকল ছইয়ের গায়ে— হুড় হুড় করে জল ঢুকতে লাগল ওর ভেতরে। ডুবে মরে যেতেই বসেচি, ভেবেচিন্তে হাত-পা ছেড়ে দিলাম, ঠিক সেই সময়ে—সত্যি কথা বলচি মশাই কারও মুখ মনে এল না—চোখের সামনে ভেসে উঠল বহুদূর পুরীর সেই শ্ৰীকৃষ্ণমূর্তি— এমন স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠল, সেই চোখ, সেই অভিমানস্ফরিত ওষ্ঠাধর, সেই মুখ। তারপর কী ঘটল আমি জানি না, যখন জ্ঞান হল তখন দেখি আমি এক গাছের তলায় শুয়ে। আমার চারপাশে দু-তিনটি লোক, আমার বুকে ওরা সর্ষের তেল মালিশ করচে।
একটা ছবি তখনই আমার বিদ্যুৎবেগে মনে এল। বললে তোমরা বিশ্বাস করবে না। তবুও বলব। বলতে হবে আমায়।
জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যাওয়ায় আগের মুহূর্তে আমি কী দেখেছিলাম জানো?
শ্ৰীকৃষ্ণমূর্তি যেন আমার দিকে সাহায্যের ভঙ্গিতে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়েচে…সে কথা কিন্তু তখন মনে হয়নি—মনে হল এখন। আমি এক লহমার মধ্যে সে অভয়দানের ছবি দেখেছিলাম।
আমার অসুস্থ মস্তিষ্কের বিকারও হতে পারে অবিশ্যি। জোর করে কিছু বলতে চাইচিনে।
বাড়িতে গিয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম প্রায় দিন সাত-আট। ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে দেখেচি পুরীর সেই কৃষ্ণঠাকুর আমার শিয়রে বসে। কত ভালবাসা তার চোখে।
সেরে উঠলাম, কৃষ্ণঠাকুর কিন্তু ছাড়ে না আমাকে। তখন তো আমার সুস্থ অবস্থা। কী করে বলি অসুস্থ মস্তিষ্কের কল্পনা।
একদিন স্পষ্টই বললে, তোমাকে ছেড়ে যাব না। কেউ আমায় ভালবাসত না, তুমি ভালবেসেছিলো।
আমি বললাম, না, এখানে তোমার কষ্ট হবে। তুমি চলে যাও তোমার সেই মঠে—
ও বললে, সেখানে আপনার লোক কেউ নেই। আমার মুখের দিকে কেউ তাকায় না। বডড হেনস্থ করে।
ও বাবা, আবার হুগলি জেলার পাড়াগায়ের মতো মুখের বুলি!
হাসি পেল আমার, হেসেই ফেললাম।
বললাম, তুমিও ভালবাসার কাঙালি?
কৃষ্ণঠাকুর মৃদু হেসে চুপ করে রইল।
দিন যায়, ডাক্তারি প্র্যাকটিস করি। প্র্যাকটিস খুব জেকে উঠেচে আজকাল, এত টাকা জীবনে কখনও রোজগার করিনি, পৈতৃক আমলের মাটির দোতলা ঘর ভেঙে ইটের দোতলা বাড়ি করব ভাবচি। একটি মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলচে বেশ ভাল ঘরেই। বিষয়ে খুব ডুবে আছি।
হঠাৎ সেদিন রাত্রে কৃষ্ণঠাকুরটি এসে হাজির ঘুমের ঘোরে।
বললাম, কী খবর?
ও হেসে বললে, ভুলে গেলে?
না। তবে—
এক বারও মনে কর না।
তা বলতে পারো বটে।
আমি কিন্তু সেখানে আর থাকতে পারাচিনে।
ও সব বাজে কথা।
আমার সেখানে ভাল লাগচে না, তুমি সেখানে নেই।
আমি কী করে থাকব, আমার সংসার নেই? তোমার কাছে বসে থাকলে আমার চলবে?
বাস, এই পর্যন্ত। আর কৃষ্ণঠাকুরকে সেদিন দেখতে পেলাম না। ঠাকুর সোজা অন্তৰ্হিত।
অনেক দিন কেটে গেল। আমার নতুন দোতলা বাড়ি উঠেচে। মেয়ের বিয়ে ভাল ঘরে হয়ে গিয়েচে। প্র্যাকটিস বেশ জমাট, দুটো নতুন ডাক্তারি আখড়া খুলেচি আমার গ্রাম থেকে দূরে, সাইকেলে যাতায়াত করি।
একদিন খুব বৃষ্টি হয়ে গিয়েচে, আবার সেই বর্ষাকাল। সন্ধের পর আমার নতুন সেন্টার থেকে রোগী দেখে ফিরচি। হঠাৎ এল ভীষণ বৃষ্টি। কাছে ছাতি নেই, বর্ষাতি নেই—পাছে ভিজে যাই এজন্যে আশ্রয় খুঁজবার জন্যে এদিক-ওদিক তাকাতে গিয়ে দেখি আমি নবিনগরের পুরনো থানাঘরের পাশেই এসে পড়েচি। একটা গাছতলায় সাইকেল রেখে ছুটে গিয়ে থানার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির ধোঁয়ায় আর সন্ধ্যার অন্ধকারে বাইরের জগৎ লুপ্ত হয়ে গেল যেন।
নবিনগরের থানাঘর সম্বন্ধে কিছু না বললে ব্যাপারটা ঠিক বোঝানো যাবে না। পাঁচশ ত্ৰিশ বছর আগে এখানে একটা ফাঁড়িঘর ছিল, কেন উঠে গেল তা বলতে পারব না। এখন কেবল মেজেটা আছে আর দাঁড়িয়ে আছে তিনটি দেওয়াল তিনদিকে। সেই তিন দেওয়ালের ওপর ভাঙা ছাদের যতটুকু দাঁড়িয়ে আছে, তারই তলায় কোনওরকমে দেওয়াল ঘেঁষে বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচবার দুরাশায় খাড়া রইলাম। ভীষণ অন্ধকার চারিদিকে।
হঠাৎ একটা ফোঁস ফোঁস শব্দে আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল।
আমার মনে পড়ে গেল পঁচিশ বছরের পুরনো ভাঙা মেজেতে দাঁড়িয়ে রয়েচি এবং দেওয়ালে মেজেতে যেখানে অসংখ্য ফাটল ও গর্ত!
খুব কাছেই ফোঁস ফোঁস করে উঠল আবার। আমি আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কোথায় কোনদিকে, কী সাপটা? এই অন্ধকারে কিছু কি ঠাওর হয়?
এমন সময় সাপটাকে আমি দেখতে পেলাম। যে দোরটা দিয়ে ঢুকেচি, সেই দোরটাতেই প্ৰকাণ্ড একটা কালীগোখুরা ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আমার অন্যদিক দিয়ে পালাবার উপায় নেই কারণ ভাঙা দেওয়ালের ইট সুরকি একদিকের পথ বন্ধ করেচে—অন্য তিনদিকের দেওয়াল তো দাঁড়িয়েই আছে।
সাপটা আমায় লক্ষ করেই ফোঁস ফোঁস করচে। এখুনি ছোবল মারল বলে। বেঘোরে প্রাণ হারালুম সন্ধ্যার অন্ধকারে। কোনও উপায় নেই। একখানা ইট তুলে মারবার চেষ্টা যে করব, সে চেষ্টা করতে সাহস পাইনে—যেই একটু নড়ব, আর অমনি ও ছোবল মারবে।
আমার তখনি মনে পড়ল সেই কৃষ্ণঠাকুরের কথা।
আর দেখা হবে না। বিদায়।
সাপটা তখনও দুলচে।
আমি একদৃষ্টি ওটার দিকে চেয়ে আছি, অন্যদিকে চোখ ফেরাতে পারাচি নে। ওর চোখের ক্রুর দৃষ্টি আমাকে সম্মোহিত করেচে।
পরক্ষণেই সাপটা ফণা নিচু করে অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল।
বাড়ি এসে সেই রাত্রে আবার কৃষ্ণঠাকুরের দেখা পেলাম। গভীর ঘুমের মধ্যে।
চোখ নাচিয়ে দুষ্টুমির সুরে বললে, কেমন?
কী, কেমন?
সাপ? আজি সন্ধেবেলা?
ওঃ বাপরে, কি বিপদেই পড়েছিলাম। মারা যেতাম আর একটু হলে আর কি—
তাই কি তোমাকে মারা যেতে দিই? ও সব আমার খেলা। দেখলাম, আমার কথা তোমার মনে আছে কি না বিপদের সময়ে। দু’বার বিপদে ফেলে দেখেচি৷
কী দেখলে?
তা বলব না। মরোনি তো আর? চলো, পুরীতে আমি একলা আছি। ভাল লাগচে না।
তারপর থেকে মশাই, প্রায়ই পুরী এসে দু-তিন মাস করে থেকে যাই।
এবার আমি অনেকক্ষণ পরে কথা বললাম।
সেই ঠাকুরটি?
সেই রকমই। পাগল মশাই, পাগল। আমাকে কোথাও যেতে দেবে না। ও আবার কি, আমার কাজকর্ম নেই মশাই, আপনারাই বলুন তো?
[রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত কিন্তু অপ্রকাশিত ‘কথা চয়ন’ সাহিত্যপত্রের দ্বিতীয় সংখ্যায় বর্তমান গল্পটি ছাপা হয়েছিল। ছাপা ফর্ম দাঙ্গার আগুনে বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘ চার দশকের ওপর এটি লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। মূল পাণ্ডুলিপিটি আমাদের হস্তগত হবার পরে আমরা বিভূতিবাবুর গল্প-সংগ্রহগুলির মধ্যে খুঁজে দেখেছি, গল্পটির হদিশ পাইনি। এ ব্যাপারে তাঁর প্রকাশক বা তাঁর পুত্ৰ কেউই কোনও সন্ধান দিতে পারেননি। তাই অনুমান হয় গল্পটি পরে আর কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এ সম্পর্কে কেউ ভিন্ন তথ্য দিতে পারলে আমরা খুশি হব।]