মঙ্গল আরতির মঙ্গল ধবনিতে জাগিয়া উঠিয়া আপনাকে শরতের মধুর জ্যোৎস্নায় মগ্ন দেখিলাম। পার্শ্বে শায়িতা সুকুমারী বালা আমারই, — আমারই সে — নির্ভয়ে নিস্পন্দে ঘুমাইতেছে। পাছে তাহার ঘুম ভাঙিয়া যায়, তাই বড় সাধ হইলেও চুম্বন করিলাম না। মধুর জ্যোৎস্নায়, মৃদুমন্দ বাতাসে, ঈষৎ্ ঘুমঘোরে দেখিলাম, ধরণী নিজ সন্তান-সন্ততি লইয়া নিশ্চিন্তভাবে নিদ্রায় মগ্ন — বুকের কাছে নিঃশঙ্ক চিত্তে বাছারা ঘুমাইতেছে — সকলেই মাতৃস্নেহে, মাতৃাদরে আপ্লুত। হেথায় পক্ষপাতিতা নাই — সকলেই মাতার সমান যত্ন স্নেহের ধন। সুমধুর জ্যোত্স্নাটুকু মায়ের হাসিখানির মত প্রকৃতি জননীকে হাস্যময়ী করিয়া তুলিয়াছে — মধুর মুগ্ধ নয়নে চাহিয়া রহিলাম — ঘুমন্ত প্রকৃতি কি সুন্দর! দেখিতে দেখিতে তখন বহু দিনের স্মৃতি জাগিয়া উঠিল — এমনই কত জ্যোৎস্নায় আপনাকে প্রিয়জনে বেষ্টিত দেখিলাম। স্মৃতিতে জ্যোত্স্না আরও মধুরতর মনে হইতেছিল, মনে পড়িল — “তখন কে জানে কারে, কে জানিত আপনারে, কে জানিত সংসারের বিচিত্র ব্যাপার।” সহসা তীব্র কণ্ঠস্বরে চমকিয়া উঠিলাম — শুনিতে পাইলাম, আমার বাতায়নের সম্মুখবর্তী পুষ্করিণীর ঘাটে একটা কথাবার্তা আরম্ভ হইয়াছে।
“কে ও? — কেষ্টদাসী, আজ যে বড় রাত থাকতে থাকতে ঘাটে এসেছিস? — কাল রাতে তোদের পাড়ায় শাঁখ বাজছিল, তোদের বৌয়ের কি এবার তবে বেটাছেলেটি হল?”
“না গো ছোট কাকী, সে কথা আর বলো না — আমাদের যেমন অদৃষ্ট, বৌয়ের আবার বেটাছেলে এ জন্মে হবে! যা হয়, একটা মেয়ে হয়েছে।”
“এবার তিনটে মেয়ে হল বুঝি?”
“হ্যাঁ গো, কাকী, তিনটে হল।”
“তা হলে গণ্ডা ভর্তি হবে — তবে যদি বেটাছেলে হয়।”
“হ্যাঁ গো খুড়ী, তারই ত মতন দেখছি। তা মেয়েটা হয়েছে শুনে দাদা বলে — কেষ্ট, আমি আর উঠতে পারি না, আমার গায়ে আর বল শক্তি নেই। মায়ের কাছে ধাই বিদেয় চাইলে, মা আসলে বিছানা থেকে উঠলো না, কথা কইলে না। বৌ মেয়ে তুলবে না; কত বলা কওয়ায় কোলে নিলে, তা বলে যে, গলা টিপে দেবো। আমি এখানে না থাকলে মেয়েটা বোধ করি মাটিতে পড়ে থেকে সদ্য মারা যেত। বাড়ী সুদ্ধ দুঃখেতে যেন কেমন হয়ে হয়েছে।”
“তা থাকবে বৈ কি, তিন তিনটে মেয়ে, কায়েতের ঘরে বিয়ে দিতে প্রাণ বেরুবে। অভাগীর মেয়ের যেমন অদৃষ্ট, দশ মাস গর্ভে ধরে কি না একটা মাটির ঢেলা হল।”
“আহা খুড়ী, পাছে এবার আবার মেয়ে হয় বলে বৌ ভেবে ভেবে আধখানা হয়ে গেছে। আর পোড়া মেয়েগুলোরও সকলই বিশ্রী কি না, এবার বৌয়ের এমন অরুচি হয়েছিল যে, পেটে জল যেত না। মেয়েটা এই সবে চার বছরের; খুকী হয়েছে শুনে বলছে, ও ত খোকা নয়, তবে ওকে বিলিয়ে দাও।”
“কচি ছেলে, ওরা যেমন শোনে তাই বুঝে; একটা একটা কথা পাকা মতন বলে ফেলে, তা আটকৌড়ে হবে ত ?”
“তা এখন কি জানি, হয়ত অমনি নিয়ম রক্ষা, আটটি ছেলে ডেকে কুলো বাজিয়ে দেবে। মা এবার কত সাধ করেছিল খোকাটি হবে, আটকৌড়েতে ভাল করে হাঁড়ি করবে, তবে ষষ্টী পুজোতে তেল সন্দেশ বিলোবে, তা কিছুই হল না, সকলই মিথ্যা হল।”
“তা মেজদিদি নরেশের বিয়ে দিক না। এর হল না হল না করে এত দিন পরে শেষে মেয়ে হতেই চললো। নরেশ একটি ছেলে, কেবল মেয়ে হলে নাম রাখবে কে ?”
“তা খুড়ী, দাদা কি করবে। এ কালের ছেলে, ওরা ঝগড়া-ঝাঁটির ভয় পায়। বৌয়ের ছেলে হল না হল না করে মা যখন হেদিয়ে দাদার বিয়ে দিতে চেয়েছিল, তখনই দাদা বিয়ে করতে চায় নি, তা এখনও ত মেয়ে হচ্ছে — ছেলে হবার আশা হয়েছে। তবে মায়ের কিনা একটি ছেলে, মা তাড়াতাড়ি সকলই চায়। বৌয়ের কিছু এমন বেশী বয়সে মেয়ে হয় নি, বছর আঠারতে বুঝি বড় মেয়েটা কোলে হয়েছে — তা মা একেবারে অস্থির হয়ে বৌকে কত ওষুধ বিষুধ খাইয়েছিল, কত মাদুলি, কত ঠাকুরের দোর ধরা, কত কি করার পর ঐ মেয়ে হল। তা তখন আশা হল, মেয়ে হয়েছে, তা এইবার তবে নাতি হবে — ও মা, বার বার তিন বার, আর কত সহ্য করবে! তা মা ত বলে যে, বৌয়ের এবার মেয়ে হলেই ছেলের আবার বিয়ে দেব। তা দাদা ত রাজী হয় না, নইলে মা কন্যে পর্যন্ত দেখে রেখেছে। আর মাও একটু চিরকাল অধৈর্য আছে। আমরা তাই বলি, অত ভেবে হাতড়ে পাতড়ে বেড়ালে কি হবে, মেয়ে হয়েছে, ছেলেও হবে, তা এবার আর আমাদের কিছু বলবার রইল না।”
এখনও সূর্যোদয় হয় নাই; ঊষার ঈষত্ মাত্র আভাস পাওয়া যাইতেছে। এখনও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ পশ্চিমাকাশে জ্বলজ্বল করিতেছে। মৃধু মৃদু সমীরণ কত দূর হইতে কেয়াফুলের সুমিষ্ট গন্ধ বহিয়া লইয়া আসিতেছে। জনকোলাহল এখনও উত্থিত হয় নাই। এমন সময় আমাদের পরিচিত গৃহিণীর কলকণ্ঠস্বরে পাড়ার সকল লোক জাগিয়া উঠিতে লাগিল। আমিও উঠিয়া জানালায় গিয়া বসিলাম। একদিকে বাখারির বেড়া এবং তিনদিকে ইমারত্-বেষ্টিত একটি ক্ষুদ্র বাগান নামধারী স্থানের মধ্যে একটি ছোট রকম পুষ্করিণী। এমন বর্ষাতে কূলে কূলে জল হইয়াছে। কিন্তু চারিপাশের জল হিংচা, কলমি, সুশনি শাকে সবুজ — কেবল মাঝখানে খানিকটা জল কতকটা পরিষ্কার আছে। পুকুরটির পাড়ে এক ধারে আম, জাম, জামরুল প্রভৃতি দু চারিটি ফলবান বৃক্ষ — বৃক্ষের তলা কেহ কখনও পরিষ্কার করে না। এক ধারে পাঁচ ছয়টি কলাগাছ — প্রায়ই তাহাদের একটি-না-একটি গাছকে ফলভারে পুকুরের উপর অবনত দেখা যায়। এক ধারে দু-একটি আধা-মরা গাঁদাফুলের গাছ — দু-একটি জীর্ণ গোলাপগাছ — কখন তাহাতে ফুল হইতে দেখা যায় না। কদাচিত্ দু-একটি কুঁড়ি দেখা যায়, কিন্তু তাহা অর্ধস্ফুট না হইতে হইতে শুকাইয়া যায়। একটি অপরাজিতা লতা, হতাদরে বেড়ার গায়ে লতাইয়া উঠিয়া বেড়ার কঙ্কালের কতক অংশ ঢাকিয়া ফেলিয়াছে — মাঝে মাঝে দু-চারিটি ফুলও লতার বুকে শোভা পায় — সে ফুলে দেবপূজাও হয়। রোপনকালে লতাটির কত না আদর ছিল, কিন্তু এখন আর কেহ তাহার দিকে চহে না — তবুও সে এখনও ধীরে ধীরে নিজ কার্য করিতেছে।
“ও মা, কথা কইতে কইতে যে ভোর হয়ে এল — আজ আর জাহ্নবী নাইতে যাওয়া হল না। তা থাক — একটু জহ্নবীর জল পরশ করব এখন — একেবারে তবে পুকুর থেকে চান করেই যাই। ওগো, ও নাতবৌ, এইখানে আমায় একটু তেল দিয়ে যা।” আজ ঘাটের শুভ দিন — ভারি মজলিস — গৃহিণী নহিলে ঘাট ভাল মানায় না।
“তাই ত বলি কেষ্টদাসি, এ-কালের ছেলেপিলে কি মা-বাপকে মানে ? আমার শ্বশুর বড় গিন্নীর (ইহার সপত্নীর) ছেলে হল না বলে অমনই আমার সঙ্গে কর্তার বিয়ে দিলেন — তা বাছা, পরমেশ্বর মুখ রক্ষা করলেন তেমন, বছর দুই বিয়ে হতে না হতে প্রথমেই আমার রাধানাথ হল — তা আঃ, কোথা গেল আমার সে ছেলে — আমি পোড়াকপালী বসে আছি — ভাগ্যিস তার দুটো গুঁড়ো আছে, তাই নিয়ে সংসারে আছি — নইলে পাগল হয়ে কোন দেশে চলে যেতুম। তারপর জানিস বাছা, তার বছরখানেক বাদে বড় গিন্নীর হরলাল হল। আমার যখন বিয়ে হল, তখন বড় গিন্নীর ছেলে হবার বয়েস যায় নি — তবে ওর বাপ শুনেছি খুব বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন — আর কর্তার চেয়ে বড় গিন্নী বছর দুয়ের বয়সে ছোট ছিল — বিয়ের সময় মাথায় প্রায় এক দেখে সুতো জোঁকা দিয়ে তবে বিয়ে হয়। আমার একটু ডাগর হয়ে বিয়ে হয়েছিল, কর্তার ত আমি দোজপক্ষের মত নই — আমিই সময়কালে বিয়ের পরিবারের মত হলুম। তা সেকালের কর্তারা অত হিসেব-কিতেব বুঝতেন না, বললেন বিয়ে কর — এঁরাও অমন এ-কালের ছেলেদের মত মা-বাপের কথা ঠেলতে পারতেন না। আমার শ্বশুর বলতেন, যে আবাগের বেটী কোঁদল করবে, সে বাপের বাড়ী গিয়ে থাকুক — আমার বাড়ী তার ঠাঁই হবে না। তাঁদের দবন ছিল কত — কর্তা বাড়ীর ভেতর এলে আমরা কচিকাঁচা বৌ-ঝি ত ভয়ে কাঁটা হতুম — ঠাকরুণ সুদ্ধ ভয়ে সারা হতেন। একেলে মেয়েরা যেমন দিবা রাত্রি স্বামীর মুখোমুখি করে থাকে — জানিস কেষ্ট, আমাদের তা হবার জো ছিল না। রাত্রে সকল নিষুতি হলে তবে ঘরে কেউ দিয়ে আসত, তবে যেতুম। এক এক দিন বারান্দায়, কি দালানে ঘুমিয়ে পড়তুম — আর কেউ ঘরে যেতে বলতে যদি ভুলে যেত, তবে সেইখানেই রাত কাটত। রাধানাথ ছ-মাসের হলে তবে শাশুড়ী একদিন রাধানাথের বিছানা ঘরে দিলেন, সেই দিন থেকে যার যেদিন পালা পড়ত, সে সেই দিন ঘরে শুতে যেতুম। আমাদের ছেলে হলে ছ’মাস কর্তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাত্ করবার হুকুম থাকত না — তবে এদানী কিছু দরকার হলে কর্তা লুকিয়ে চুরিয়ে ভাঁড়ার ঘরে, কি রান্নাঘরে এসে বলে যেতেন। তা বাছা, আমরা দিনের বেলা কথা কইতুম না, শাশুড়ী টের পেলে গঞ্জনা সইতে হবে, এমন কথা নাই বা কইলুম। তা এ কালে সব রকমই আলাদা দেখে শুনে হাত পা পেটের মধ্য সেঁধিয়ে যাচ্ছে।”
মুখে অনর্গল বক্তৃতা চলিতেছে — হস্ত তৈলসমেত সর্বাঙ্গে সঞ্চালিত হইতেছে। ক্রমে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে অনেকগুলি রমণীমুখকমল ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। সকলেরই মন গৃহিণীর বক্তৃতার দিকে, সকলেই নিজ নিজ স্নান ভুলিয়া গিয়াছেন — কাহারও দাঁত মাজা আর শেষ হয় না, কেহ গামছা দিয়া গাত্র মর্দন করিয়াও তৃপ্ত হইতেছেন না। মূল কথা, মিত্রদের মেয়েটা হইয়াছে শুনিয়া সকলেই — তাই ত, আহা, মেয়েটা হল, বেটাছেলেটি হলেই সার্থক হত, বলিয়া আহা উহু করিতেছেন। একজন আশ্বাস দিয়া কহিলেন, “তা হোক, কত লোকের সাত মেয়ের পর ছেলে হয় — আমার পিসতুত বোনের সেদিন চার মেয়ের পর খোকাটি হয়েছে — খোকাটি এই ষেটের এক বছরের হল।”
এই রমণীমণ্ডলীর মধ্যে দু-একটি ঘোমটাবৃত যুবতী বধূ ও কন্যা স্নান করিতেছিল — একটি চতুর্দশবর্ষীয়া কন্যা আর থাকিতে পারিল না। মাতৃ সম্বোধনে কৃষ্ণদাসীকে কহিল, “তা মা, মামীর মেয়ে হয়েছে বলে তোমাদের দুঃখু রাখবার যেন ঠাঁই নেই, তাই ঘাটে এসেও সেই কাহিনী হচ্ছে — তা তুমি যা বল, আমার কিন্তু বাপু ঘোষদের কালো কালো ছেলের চেয়ে মামীর মেয়েদের বেশ ভাল লাগে — অমন একটা কালো ছেলের চেয়ে সাতটা সুন্দর মেয়ে ভাল। তোমাদের এক কথা, মেয়ে বুঝি কোন কাজে লাগে না ? তুমি এই যে আষাঢ় মাসে এখানে এসেছ, দু-তিন মাস যে করে দিদিমার সেবা করছ, মামা তেমন করে ? দিদিমাই ত দুঃখ করেন, আমার মেয়ে অসময়ে যত করে, ছেলে আমার তেমন করে না। তার বেলা বুঝি মেয়ের দরকার — এদিকে মেয়ে হয়েছে শুনলেই সর্বনাশ বাধে। এই যে ও বাড়ীর ছোট ঠাকুরমা — কাকা ত এক পয়সা আনতে পারেন না — যাই ক্ষেমা পিসি ছিলেন, তিনি খরচপত্র দিচ্ছেন, তবে কাকার সুদ্ধ চলছে। কিন্তু শুনেছি, ক্ষেমা পিসির আগে আর দু বোন হয়, তাই ওঁর নাম ক্ষেমা রেখেছিল।” এমন বিদ্রোহসূচক কথা শুনিয়া ঘাটসুদ্ধ সকলে অবাক হইয়া গেল। কাক আর ডাকে না, গাছের পাতা আর নড়ে না। গৃহিণী হাসিয়া কহিলেন, “ওলো পেরভা, থাম থাম, যখন তোর হবে, তখন বুঝবি — এখন ছেলেমানুষ কি বুঝবি — ছেলেমানুষের মুখে অত পাকা পাকা কথা ভাল শোনায় না।”
“তা ছোট ঠাকুরমা, সত্যি কথা বলছি — কেন এই ও-বাড়ীর ছোট মামীও বলছেন যে, ওঁর যদি মেয়ে হয়, তাতে কিছু দুঃখু হবে না। মামীও যে মেয়েদের কত ভালবাসেন, কেবল দিদিমার লাঞ্ছনার ভয়েই ত পাছে মেয়ে হয় বলে অত ভয় পান। মেয়ে হয়েছে, এখন ছেলে হবার সাধ হয়, দিদিমার ভয়ে মেয়েদের ভাল করে আদর পর্যন্ত করতে পারেন না। মামাবাবু ভয়ে পুজোর ভাল কাপড় অবধি করতে দিতে সাহস পেলেন না — নইলে মেয়েকে দিতে তাঁর ইচ্ছে হয় — কে জানে বাপু, তোমরা কি বোবা — তোমরা কি মেয়ে নও — ?”
“হ্যাঁগো গো জ্যাঠাইমা ঠাকরুণ, আমরা মেয়ে বটে, তা আমার কত আদর ছিল জানিস ? আমি মায়ের প্রথম সন্তান — দিদিমার আদুরে, ঠাকুরমার আদুরে — ঠাকুরমা বলতেন, ও কি আমার মেয়ে, ও আমার সাত বেটা, তা বলে বাপু গণ্ডা গণ্ডা মেয়ে হওয়া গৃহস্থের অলক্ষণ।”
ক্রমে প্রভার সমবয়স্কা আরও দু-চারটি কন্যা ঘাটে আসিয়া জুটিল। হরিদাসী কহিল, “কি ঠানদিদি, আজ যে ঘাট জাঁকিয়ে তুলেছ, ব্যাপারখানা কি ?”
“কি লো হরিদাসি, এসেছিস ? তাই ত বলি, তুই নইলে কি ঘাট মানায় ? আমরা বুড়ো মানুষ, আমরা আর ঘাট জাঁকাব কি, দুটো দুঃখের সুখের কথা কইছি বই ত নয়। তোদেরই এখন জাঁকের বয়েস — তাই বলছিলুম; বলি হরিদাসী যে এখনও এল না — কাল রাতে বুঝি নাতজামাই এসেছিল ?”
“সে আমি কি জানি ঠানদিদি, সে তোমরা জান। আমরা ঘাটে আসতে আসতে পথের ধারে হরকালী কাকার বাড়ী গেছলুম — তাদের খোকা হয়েছে দেখে এলুম; তাই আসতে একটু দেরি হল।”
“বটে! ওদের কেমন অদৃষ্ট দেখেছিস — এখন সময় ভাল, সব দিকে ভাল হয় — বৌয়েদের কেবলই বেটাছেলে হচ্ছে। আর ঘটাও তেমনি করে — এই আটকৌড়েতে হাঁড়ি করা রে — ষষ্ঠী পুজোয় তেল সন্দেশ দেওয়া রে — ভাতে বোগনো করা রে — খাওয়ানো রে, দাওয়ানো রে, সব করে। কেষ্টর মার যেমন অদৃষ্ট — একটা বৌ — কেবল গণ্ডা গণ্ডা মেয়ে হচ্ছে।”
হরিদাসী। “— তা হলই বা — মেয়ে বুঝি ফেলনা ?”
“ও বাবা! তোদের এ কালের যে সবই সমান দেখি — পেরভাও ঐ কথা নিয়ে কত মুখনাড়া দিলে — মেয়েছেলে আবার কোন কাজের গো ?”
“কোন কাজের নয় গো ? বাপ মা, স্বামী পুত্র, কারও অসুখ হোক, কারও অনটন হোক, মেয়েতে যত করে, এত কোন ছেলেতে করে গো ? মাকে মেয়ে যত যত্ন করে, মায়ের দুঃখ যত মেয়েতে বোঝে, এত কি ছেলেতে বোঝে ? ওগো, ওগো, স্ত্রীলোক হচ্ছে লক্ষ্মী — হাজার টাকাকড়ি থাক, দেখ, যে বাড়ীতে গৃহিণী নেই, সে ঘরকন্না কেমন বেশৃঙ্খল, যে ছেলেদের মা নেই, সে ছেলেপিলের কত অযত্ন! মেয়ে হয়েছে শুনেই তোমরা লাফিয়ে ওঠ, কি না বিয়ে দিতে হবে! তা বাপু, ছেলের জন্য কি কিছু খরচ নেই ? সেনেদের বাড়ী দেখতে পাই, ছেলেদের খাওয়া হলে তবে সেই পাতে মেয়েদের অমনি যা তা দিয়ে খেতে দেয়। ছেলেদের জুতো জামা, সাফ কাপড়, মেয়েদের ময়লা পাঁচী ধুতি। ছেলেদের দু পয়সা করে এক এক জনের খাবার বরাদ্দ, মেয়েদের এক পয়সার আটার রুটি করে তিন চারটিকে দেয়। ছেলেরা ভাল গদিতে খাটে শোয় — মেয়েগুলি মেঝেতে মাদুরে একটা ছেঁড়া লেপ পেতে শোয়। বড় বড় ছেলেরাও মা বাপের সঙ্গে শুতে পায়, ছোট বোন দুটি রাঁধুনীর কাছে শোয়। — আহা, তাদের যদি একটু যত্ন আছে! সেদিন ও বাড়ীর মেজ কাকীর মেয়ে মামার বাড়ী থেকে বাড়ী এসেছে, ঠাকুরমার কাছে সকালে ভাত চেয়েছে, তখনও কেউ খায়নি বলে ঠাকুরমা স্বচ্ছন্দে তাকে বললে কিনা, মেয়েমানুষ আগ দোফের ভাত খাবে কি! এখনও কেউ খায়নি, আগে আগে ভাত দাও! আগে বাপ খুড়ো খাগ, তবে সে পাতে খাস। আহা, সে ছ-সাত বত্সরের মেয়ে, অত কি জানে, ভাতের জন্য কাঁদতে লাগল, শাশুড়ির ব্যাভার দেখে মেজ কাকীমা রাগ করে তখনই তাকে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিলে। আমাদের কাছে কত দুঃখু করতে লাগল যে, বাছা একদিন বাড়ী এল, দুটো ভাতের জন্যে কেঁদে চলে গেল। এ কি মায়ের প্রাণে সয়! তা কে জানে, মেয়ে আদরের না অনাদরের!”
“বাবা, এ-কালের মেয়েগুলোর মুখের তোড় দেখ, যেন ঝড় বয়ে গেল, যা যা, আর জলে পড়ে থাকিস নে, অসুখ হবে।”
যাহা হউক, অল্পবয়স্কারা আর অধিক উত্তর প্রত্যুত্তর করিল না। তাহারা স্নান সমাপনান্তে গৃহে চলিয়া গেল। সকলেই আসিতেছে, অল্পবিস্তর শুনিয়া চলিয়া যাইতেছে, কিন্তু পুষ্করিণী - অধিকারিণীর সেই তৈলমর্দনই চলিতেছে। এমন সময় ব্যস্ত সমস্ত হইয়া হরকালীর মায়ের প্রবেশ — কি ব্যাপার! — ইনি ভারি ব্যস্ত — ইঁহারই গৃহে কাল শাঁখ বাজিয়াছে — বধূর পুত্রসন্তান হইয়াছে।
“এ কি — ঠাকুরঝি যে, আজ গঙ্গা নাইতে যাসনি ? আমি বলি, আজ কেবল আমারই যাওয়া হয় নি — তা বোন, কি করি, মেজ বৌমার কাল রাত্রে বেটাছেলেটি হল — তা ফেলে যাই কি করে ? জানিস ত, এ কালের মেয়েগুলো সব বিবি হয়েছে — তাপ সেঁক নেবে না, ঝাল খাবে না। আমি তেমন মেয়ে নই — ঐ জন্যে বৌয়েদের কখন প্রসবকালে বাপের বাড়ী পাঠাই না। সেজ বৌয়ের বাপ আবার ডাক্তার, তিনি তাপ নিতে দেবেন না, ঝাল খেতে দেবেন না — মেয়েকে গদি পেতে শোয়াতে চান। জান ঠাকুরঝি, আমাদের যেমন নিয়ম আছে, ডাক্তার বলেন, ও সব ফেলে দাও — আমি তেমন মেয়ে নই - এই বসে বৌকে ভাজা ভাজা করে তাপ দিয়ে এলুম, এইবার নেয়ে গিয়ে ঝাল খেতে দেব। ডাক্তার আছেন, তিনি আছেন, — তাঁর মেয়ে ঘরে এনে কি আমি নিয়মভঙ্গ করব। সে বার আঁতুড়ে সেজ বৌয়ের মেয়েটা গেল, ডাক্তার দেখতে এসে বললেন, এই সব স্যাঁতানে জায়গায় পড়ে ব্যায়ারাম হয়েছে, — বলে আঁতুড় নাড়তে চান — আমি তা কিছুতে করতে দিই নি।”
“সে মেয়েটার কই কি ব্যায়ারাম হয়েছিল, আমি ত শুনি নি — তাঁর উপর না সেই বাবার দৃষ্টি পড়েছিল ?”
“তাই ত বলছি ভাই — ওঁরা বড় বোঝেন, শিশি শিশি ওষুধ এল, গেলাতে চান — গিলবে কে ? — বাবা মুখ চেপে ধরে আছেন — সে জ্ঞান নেই। ও রোগের যা, রোজা এনে সব করলুম, তা কিছু হল না। হবে কি — রোজা বললে যে, পোয়াতি চাঁপাফুলের গাছের নীচে গেছল — তাই দৃষ্টি পড়েছে। সাহেবের মেয়ে, বেটী হয়ত কোন গাছতলায় মাছতলায় গেছল, ও সব ত মানা হয় না। এবার আমি আর বাপের বাড়ীমুখো হতে দিই নি। সেবার যেন মেয়েটা গেল গেল, কিছু ক্ষতি হল না — এবার বেটাছেলেটি হয়েছে, একটু ভাল করে তাপ সেঁক না দিলে কি হয় ? পোয়াতি ভাল থাকলে, তবে ছেলের পিত্তেশ — কি বলিস ভাই ?”
“তা বই কি, বংশ রক্ষার জন্য বৌয়ের আদর, নইলে পরের মেয়ে ঘরে এনে জঞ্জাল বই ত নয়। তা হোক, বেটাছেলেটি হয়েছে — আটকৌড়েতে হাঁড়ি করিস। তোদের সূতিকাপুজো আছে ত ?”
“হ্যাঁ, সূতিকাপুজো হবে বই কি — তা লক্ষ বামনের পায়ের ধুলো কোথায় পাব, — বারোটি বামনের পায়ের ধুলো দেব — আর পূজা আশ্রয় সব হবে। আটকৌড়ে যেমন আর সব বৌয়ের ছেলেদের বেলা করেছি, এরও তেমনি হবে — এক হাঁড়ি জলপান, একটি করে সিকি, চারটে করে মেঠাই, এই সব ঘরে ঘরে দেব — আর বাড়ীতে ছেলেরা যারা আসবে, তাদের বেটাছেলেদের দু আনা, মেয়েদের চার পয়সা করে দেব। আর বেঁচেবত্তে থাকে ত ভাতটিও দিতে হবে। যেমন বেটাছেলেটি হয়েছে আহলাদের, তেমনি খরচপত্রও হবে। এই ধাইকে নগদ এক টাকা, একটা ঘড়া কালই দিতে হল — আবার আসবে বিদেয় নিতে। মেয়ে হলে, সেই যা নাড়ীকাটা একটা টাকা ধার আছে — আর কি!”
“তা পরমেশ্বর দিন দিয়েছেন, আমোদ আহলাদ খরচপত্র করবি বই কি! আমার দু মেয়ে এখানে আছে, আমার ঘরে তিনটে হাঁড়ি দিস, আর আমার সতীন-পো বৌও ভিন্ন হয়েছে।”
“হ্যাঁ ভাই, তা বললে ভাল। এই বাড়ী গিয়ে হাঁড়ির ফর্দ করতে হবে। আবার বাজনা আসবে, তবে নাচ আসবে, তার বিদায় খরচ ঢের” —
“শুনেছিস, মিত্তিরদের বৌয়ের আবার মেয়ে হয়েছে!”
“ও মা, বলিস কি, আবার মেয়ে — কে বললে ?”
“এই কেষ্ট রাত থাকতে এসেছিল, আঁতুড় ছুঁয়েছিল কিনা, সেই কত দুঃখ খেদ করতে লাগল — তারই সঙ্গে কথায় কথায় জাহ্নবী নাইতে যাওয়া হল না — আমি ভোরে কাপড় কাচতে এসেছি, আর কেষ্ট এল।”
“হ্যাঁ ঠাকুরঝি, গঙ্গা তোমার কার নাম গা ?”
“আমার ছোট খুড় শাশুড়ীর নাম ফঙ্গামণি, তাই আমরা জাহ্নবী বলি — ঠাকুরদের নাম আমাদের প্রায় করবার জো নেই। আমাদের বৃহত্ পরিবার, সকল নাম বেছে চলতে হয় ত — আমরা ত একেলে নই যে, সুদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ীর নামটি হদ্দ মেরে কেটে বাছব।”
“তাই ত ঠাকুরঝি, মিত্তিরদের বৌটো কি গা — এবার গোটা চার পাঁচ মেয়ে হল বুঝি — আমার বড় বৌমার ষেটের কোলে এই দুটি; দুটি নষ্ট হয়েছে; তাই শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে মেজ বৌমারও দুটি বেটা, একটা মেয়ে, তা মেয়েটা মামার বাড়ী থাকে, দিদিমার আদুরে, মেজ বৌমা বাপের একটি মেয়ে কি না তা ঐ প্রথম মেয়ে দিদিমাই মানুষ করেছে, সে মেয়ের ভার আর আমাদের নিতে হবে না — দিদিমা তাকে হাতের তেলোয় আর নাচিয়ে নাচিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, বেটাছেলে করে কাপড় পরানো হয়, হেমন্তকুমারী নাম, তা হেমবাবু বলে ডাকা হয়। সে মেয়ের আদিখ্যেতা কত। আর সেজ বৌয়ের দুটো মেয়ের একটা সেই আঁতুড়ে গেছে, আর এই খোকাটি হয়েছে।”
“তা বেঁচে থাক, আমরা সব পাঁচ কম্র্মে যাব, খাব, নেব। আমাদের ঘরের কথা। মেয়েগুলো কেবল মিথ্যা বই ত নয়। সূতিকাপুজো নেই, আটকড়াই কর আর না কর, ভাত — তা বড় সাধ হয় ত পাঁচজনকে এনে খাওয়াও। একটু কেবল পেসাদ মুখে দেওয়া, তার ক্রিয়া নেই কম্র্ম নেই, পিতৃপুরুষ এক গণ্ডুষ জল পায় না। ঐ যা বিয়ের সময় একবার পিতৃপুরুষ জল পান বই ত নয়।”
“যাই, এই বেলা বাড়ী যাই; সেজ বৌয়ের বাপ হয়ত এসে এতক্ষণ কত হাঙ্গামা করছে। ছেলেরা ছেলেমানুষ, তারা ত কথা কইতে বড় পারে না — আমি এমন জবরদস্তি না হলে রক্ষা ছিল! আর ছেলেগুলোরও ঐ মত — সব একেলে কিনা। তা আমার উপর বড় কথা কয় না, বেশী বললেই আমি বলি যে, এখন বড় হয়েছিস, আমায় মানবি কেন ? আমি তোদের চারটি নিয়ে বিধবা হয়ে কত কষ্ট করে তোদের এত বড় করলুম, এখন আমি পর হলুম, শ্বশুরই আপনার হল। তা ওরা আর কথা কইতে পারে না। এই ছোট ছেলে - ঐ একটু মুখেফোঁড় — আর কোলের কিনা, আদুরে — ওকে কিছু বলতে পারি নে, ও আঁতুড়ে মাতুড় ছুঁয়ে নেপে সৃষ্টি করে। এই আঁতুড় উঠবে আর বৌগুলোকে দিয়ে নেপ বালিশ পর্যন্ত সব কাচিয়ে নেব।”
“ও সব আর বলিস নে - জাত জন্ম আর রইল না। এ কালের ছেলে, ওরা সব এক রকম। আমার ছোট জামাই অমনি, সে বার বিধু প্রসব হতে এখানে এসেছিল, জামাই রোজ দেখতে আসত, সেই বিছানায় বসে গল্পসল্প করে চলে যেত। প্রথম যে দিন এল — আমি তখন নাইতে গেছি — মালা হাতে করে দাঁড়িয়েছি, আর আঁতুড় থেকে বেরিয়ে খপ করে পায়ের ধুলো নিলে। কি করব, বললুম — ‘বাবা, আঁতুড় ছুঁয়ে কি আমায় ছুঁতে আছে ? আবার হাতে মালা।’ তা অপ্রস্তুত হয়ে বলে, ‘আমার অত মনে ছিল না।’ আমি আর কি করব — মালা গেল, আবার পুকুরে নেয়ে মরি। তা জামাইয়ের যে মত, মেয়েকে সেই মতেই রাখতে হয় — আমি লুকিয়ে দুটো দুটো গুঁড়ো ঝাল দিই — মেয়েগুলোও তেমনি, হাত পেতে নিলে, কতক খেলে, কতক বা না খেলে, — বলে, ‘ঝাল খেলে মা কেবল জলতেষ্টা বাড়ে বই ত নয়, তোমরা ত জল দেবে না — সুদ্ধ সাবু খেয়ে থাকলে তেষ্টাও হয় না, জলও চাই না।’ কে জানে ভাই, ওদের কেমন কথা। আঁতুড়ে তেষ্টা পায় না — আমাদের এমনি তেষ্টা ছিল যে, অতি ময়লা জলও এক কোষ চুরি করে খেয়েছি। আমাদের কালে ঝাল দিয়ে সুদ্ধ মুখ ধুতে জল দিত। তাতে কি প্রাণ বাঁচে!”
“তা বই কি, আমার এই চারটি গুঁড়ো হয়েছে, ফি বারই আঁতুড়ে মাগীকে পয়সা দিয়ে পায়ে হাতে ধরে জল চুরি করে খেয়েছি। এদিকে ভাজা ভাজা তাপ, ওদিকে সরা সরা ঝাল — যেমন তেষ্টা, তেমনি গা’র জ্বালা — ওতেই ত শরীর ঝনঝনে হয়। ঐ গো, বাজনা এসেছে, তবে আজ আসি।” বলিয়া গামছা নিংড়াইতে নিংড়াইতে ভিজা কাপড়ের অঞ্চল স্কন্ধে ফেলিয়া প্রস্থান।
গৃহিণী। “দেখেছিস গয়লা বৌ, হরকালীর মায়ের তেজ দেখেছিস! অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়ে না, আপনার চার ছেলে বলে কেবল জানানো হয় আমার চারটি গুঁড়ো। যমের জ্বালা ভুগতে হয় নি, তাই অত জাঁক — ছেলে হলেই ত হয় না। বাঁচাই মূল। যমে না সর্ব্বনাশ করলে আমিও আজ রাজার মা।”
গয়লা বৌ —। “তা বই কি মা ঠাকরুণ, যমের জ্বালা বড় জ্বালা। আমার দু ছেলে দু মেয়ে যমকে দিয়েছি, এখন দুটি মেয়ে একটি ছেলে নিয়ে প্রাণ ধরে আছি - বড়টি শ্বশুরবাড়ী গেছে; মা, কেঁদে কেঁদে মরছি। মা, আমরা দুঃখী মানুষ, তা বাছারা আমার এমন যে, আমার পয়সা নেই, কেমন বোঝে — পাছে চাইলে না দিতে পারি, তাই এত সোনার সামগ্রী পাড়ায় আছে, কখনও খেতে কিনতে চায় না।”
গৃহিণী। “তোর মেয়েটি না বেশ ভাগ্যিমন্তের ঘরে পড়েছে?
গয়লা বৌ। “হ্যাঁ মা, তোমার আশীর্বাদে তারা বড় ভাগ্যিমন্ত, আর আমার নয়নতারাকে খুব যত্ন করে। কিন্তু তা হলে কি মায়ের মন বোঝে — আমি যে সকালে এক পয়সার মুড়ি, তিনজনকে দিতে পারি না, তাতে যে আমার বুক ফেটে যায়।”
গৃহিণী। “তা কি করবি, কাঁদিস নে, চুপ কর। মেয়েজন্ম পরের ঘরে যাবার জন্যেই হয়েছে। তাই ত বলি গয়লা বৌ, মেয়েগুলো মিথ্যা। দু দিন বাদে পরের ঘর যাবে — তা বলে এ কালের মেয়েদের কাছে তা বলবার জো নেই।”
গয়লা বৌ। “তা মা, দু দিন বাদে শ্বশুরবাড়ী যাবে বলেই ত আমার প্রাণ কেমন করে। তা জন্যেই ত মা, আমি মেয়ে দুটিকে না দেখে থাকতে পারি নে। বেটাছেলে মা, বেঁচে থাকলে ওরা আপনারা আনবে নেবে, বৌ হবে, আদর যত্ন চিরদিন পাবে — আমার প্রাণ ঠাণ্ডা থাকবে। মেয়েদের মা না করলে আর কে করবে? শাশুড়ী ননদ অত করবে না — দু দিন বাদে মেয়েরা আবার মা হবে — আপনার ছানাপোনা নিয়েই ব্যস্ত হবে। আজ যদি মা আমি না আদর করি ত কে আর তাদের আদর করবে?”
গৃহিণী। “তা বই কি! তোর ঢের গেছে কি না, তাই তোর বেশী মায়া — নইলে জগত্ জুড়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের আদর কম। ছেলেটি হয়েছে বলতে দশ হাত বুক হয় — শুনতে কেমন। ঘটাঘটি আমোদ আহলাদ হয়। সাত ছেলে হলেও অরুচি নেই। মেয়ে প্রথম হলে, লোকে বলে, তা হউক — এইবার ছেলে হবে। প্রথম যা হয়েছে, বেঁচে থাক — জেঁয়াচ বজায় থাকলে তবে ত মঙ্গল। তবে ত ছেলের পিত্তেশ।”
গয়লা বৌ। “হ্যাঁ মা, যাই — বেলা হল।”
ক্রমে ঘাট শূন্য হইয়া আসিল, স্বপ্নময় মোহমুগ্ধ নয়নে আসিয়াছিলাম, সত্যের তীব্রতা লইয়া ফিরিলাম। প্রকৃতি জননীর আর সেই মধুর স্নেহময় ভাব নাই — এখন চারিদিকে কর্তব্যের ঘোর শাসনকর্তব্য লইয়া সকলে ছুটাছুটি করিতেছে। নয়নে আর সেই মোহ নাই — সূর্যালোকে সকলই পরিষ্কার স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। মনে জাগিতেছে আদরের, না অনাদরের! স্নেহেও পক্ষপাতিতা আছে — শুধু স্নেহে নহে — মাতৃস্নেহও আছে — মাতাও কন্যা অপেক্ষা পুত্রকে অধিক স্নেহ ও যত্ন করিয়া থাকেন। ভাবিতে ভাবিতে শয্যাসম্মুখে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম, আমার সে ফুলটি এখনও ফুটিয়া উঠে নাই — আমার চুম্বনের সূর্যালোকে এখনও সে ফুল স্পর্শ করে নাই, তাই এখনও সে ফোটে নাই — নিঃশঙ্ক সুষুপ্ত মুখে যেন লেখা রহিয়াছে পড়িলাম —
“অনুগ্রহ করে এই করো, অনুগ্রহ করো না এ জনে।”
আমি তাহাকে চুম্বন করিলাম — হাসিয়া আঁখি মেলিয়া সে আমার মুখের পানে চাহিল। আমি বুকে টানিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম — মা আমার, তুমি আদরের না অনাদরের?
— আমি আদরের!
“কে ও? — কেষ্টদাসী, আজ যে বড় রাত থাকতে থাকতে ঘাটে এসেছিস? — কাল রাতে তোদের পাড়ায় শাঁখ বাজছিল, তোদের বৌয়ের কি এবার তবে বেটাছেলেটি হল?”
“না গো ছোট কাকী, সে কথা আর বলো না — আমাদের যেমন অদৃষ্ট, বৌয়ের আবার বেটাছেলে এ জন্মে হবে! যা হয়, একটা মেয়ে হয়েছে।”
“এবার তিনটে মেয়ে হল বুঝি?”
“হ্যাঁ গো, কাকী, তিনটে হল।”
“তা হলে গণ্ডা ভর্তি হবে — তবে যদি বেটাছেলে হয়।”
“হ্যাঁ গো খুড়ী, তারই ত মতন দেখছি। তা মেয়েটা হয়েছে শুনে দাদা বলে — কেষ্ট, আমি আর উঠতে পারি না, আমার গায়ে আর বল শক্তি নেই। মায়ের কাছে ধাই বিদেয় চাইলে, মা আসলে বিছানা থেকে উঠলো না, কথা কইলে না। বৌ মেয়ে তুলবে না; কত বলা কওয়ায় কোলে নিলে, তা বলে যে, গলা টিপে দেবো। আমি এখানে না থাকলে মেয়েটা বোধ করি মাটিতে পড়ে থেকে সদ্য মারা যেত। বাড়ী সুদ্ধ দুঃখেতে যেন কেমন হয়ে হয়েছে।”
“তা থাকবে বৈ কি, তিন তিনটে মেয়ে, কায়েতের ঘরে বিয়ে দিতে প্রাণ বেরুবে। অভাগীর মেয়ের যেমন অদৃষ্ট, দশ মাস গর্ভে ধরে কি না একটা মাটির ঢেলা হল।”
“আহা খুড়ী, পাছে এবার আবার মেয়ে হয় বলে বৌ ভেবে ভেবে আধখানা হয়ে গেছে। আর পোড়া মেয়েগুলোরও সকলই বিশ্রী কি না, এবার বৌয়ের এমন অরুচি হয়েছিল যে, পেটে জল যেত না। মেয়েটা এই সবে চার বছরের; খুকী হয়েছে শুনে বলছে, ও ত খোকা নয়, তবে ওকে বিলিয়ে দাও।”
“কচি ছেলে, ওরা যেমন শোনে তাই বুঝে; একটা একটা কথা পাকা মতন বলে ফেলে, তা আটকৌড়ে হবে ত ?”
“তা এখন কি জানি, হয়ত অমনি নিয়ম রক্ষা, আটটি ছেলে ডেকে কুলো বাজিয়ে দেবে। মা এবার কত সাধ করেছিল খোকাটি হবে, আটকৌড়েতে ভাল করে হাঁড়ি করবে, তবে ষষ্টী পুজোতে তেল সন্দেশ বিলোবে, তা কিছুই হল না, সকলই মিথ্যা হল।”
“তা মেজদিদি নরেশের বিয়ে দিক না। এর হল না হল না করে এত দিন পরে শেষে মেয়ে হতেই চললো। নরেশ একটি ছেলে, কেবল মেয়ে হলে নাম রাখবে কে ?”
“তা খুড়ী, দাদা কি করবে। এ কালের ছেলে, ওরা ঝগড়া-ঝাঁটির ভয় পায়। বৌয়ের ছেলে হল না হল না করে মা যখন হেদিয়ে দাদার বিয়ে দিতে চেয়েছিল, তখনই দাদা বিয়ে করতে চায় নি, তা এখনও ত মেয়ে হচ্ছে — ছেলে হবার আশা হয়েছে। তবে মায়ের কিনা একটি ছেলে, মা তাড়াতাড়ি সকলই চায়। বৌয়ের কিছু এমন বেশী বয়সে মেয়ে হয় নি, বছর আঠারতে বুঝি বড় মেয়েটা কোলে হয়েছে — তা মা একেবারে অস্থির হয়ে বৌকে কত ওষুধ বিষুধ খাইয়েছিল, কত মাদুলি, কত ঠাকুরের দোর ধরা, কত কি করার পর ঐ মেয়ে হল। তা তখন আশা হল, মেয়ে হয়েছে, তা এইবার তবে নাতি হবে — ও মা, বার বার তিন বার, আর কত সহ্য করবে! তা মা ত বলে যে, বৌয়ের এবার মেয়ে হলেই ছেলের আবার বিয়ে দেব। তা দাদা ত রাজী হয় না, নইলে মা কন্যে পর্যন্ত দেখে রেখেছে। আর মাও একটু চিরকাল অধৈর্য আছে। আমরা তাই বলি, অত ভেবে হাতড়ে পাতড়ে বেড়ালে কি হবে, মেয়ে হয়েছে, ছেলেও হবে, তা এবার আর আমাদের কিছু বলবার রইল না।”
এখনও সূর্যোদয় হয় নাই; ঊষার ঈষত্ মাত্র আভাস পাওয়া যাইতেছে। এখনও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ পশ্চিমাকাশে জ্বলজ্বল করিতেছে। মৃধু মৃদু সমীরণ কত দূর হইতে কেয়াফুলের সুমিষ্ট গন্ধ বহিয়া লইয়া আসিতেছে। জনকোলাহল এখনও উত্থিত হয় নাই। এমন সময় আমাদের পরিচিত গৃহিণীর কলকণ্ঠস্বরে পাড়ার সকল লোক জাগিয়া উঠিতে লাগিল। আমিও উঠিয়া জানালায় গিয়া বসিলাম। একদিকে বাখারির বেড়া এবং তিনদিকে ইমারত্-বেষ্টিত একটি ক্ষুদ্র বাগান নামধারী স্থানের মধ্যে একটি ছোট রকম পুষ্করিণী। এমন বর্ষাতে কূলে কূলে জল হইয়াছে। কিন্তু চারিপাশের জল হিংচা, কলমি, সুশনি শাকে সবুজ — কেবল মাঝখানে খানিকটা জল কতকটা পরিষ্কার আছে। পুকুরটির পাড়ে এক ধারে আম, জাম, জামরুল প্রভৃতি দু চারিটি ফলবান বৃক্ষ — বৃক্ষের তলা কেহ কখনও পরিষ্কার করে না। এক ধারে পাঁচ ছয়টি কলাগাছ — প্রায়ই তাহাদের একটি-না-একটি গাছকে ফলভারে পুকুরের উপর অবনত দেখা যায়। এক ধারে দু-একটি আধা-মরা গাঁদাফুলের গাছ — দু-একটি জীর্ণ গোলাপগাছ — কখন তাহাতে ফুল হইতে দেখা যায় না। কদাচিত্ দু-একটি কুঁড়ি দেখা যায়, কিন্তু তাহা অর্ধস্ফুট না হইতে হইতে শুকাইয়া যায়। একটি অপরাজিতা লতা, হতাদরে বেড়ার গায়ে লতাইয়া উঠিয়া বেড়ার কঙ্কালের কতক অংশ ঢাকিয়া ফেলিয়াছে — মাঝে মাঝে দু-চারিটি ফুলও লতার বুকে শোভা পায় — সে ফুলে দেবপূজাও হয়। রোপনকালে লতাটির কত না আদর ছিল, কিন্তু এখন আর কেহ তাহার দিকে চহে না — তবুও সে এখনও ধীরে ধীরে নিজ কার্য করিতেছে।
“ও মা, কথা কইতে কইতে যে ভোর হয়ে এল — আজ আর জাহ্নবী নাইতে যাওয়া হল না। তা থাক — একটু জহ্নবীর জল পরশ করব এখন — একেবারে তবে পুকুর থেকে চান করেই যাই। ওগো, ও নাতবৌ, এইখানে আমায় একটু তেল দিয়ে যা।” আজ ঘাটের শুভ দিন — ভারি মজলিস — গৃহিণী নহিলে ঘাট ভাল মানায় না।
“তাই ত বলি কেষ্টদাসি, এ-কালের ছেলেপিলে কি মা-বাপকে মানে ? আমার শ্বশুর বড় গিন্নীর (ইহার সপত্নীর) ছেলে হল না বলে অমনই আমার সঙ্গে কর্তার বিয়ে দিলেন — তা বাছা, পরমেশ্বর মুখ রক্ষা করলেন তেমন, বছর দুই বিয়ে হতে না হতে প্রথমেই আমার রাধানাথ হল — তা আঃ, কোথা গেল আমার সে ছেলে — আমি পোড়াকপালী বসে আছি — ভাগ্যিস তার দুটো গুঁড়ো আছে, তাই নিয়ে সংসারে আছি — নইলে পাগল হয়ে কোন দেশে চলে যেতুম। তারপর জানিস বাছা, তার বছরখানেক বাদে বড় গিন্নীর হরলাল হল। আমার যখন বিয়ে হল, তখন বড় গিন্নীর ছেলে হবার বয়েস যায় নি — তবে ওর বাপ শুনেছি খুব বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন — আর কর্তার চেয়ে বড় গিন্নী বছর দুয়ের বয়সে ছোট ছিল — বিয়ের সময় মাথায় প্রায় এক দেখে সুতো জোঁকা দিয়ে তবে বিয়ে হয়। আমার একটু ডাগর হয়ে বিয়ে হয়েছিল, কর্তার ত আমি দোজপক্ষের মত নই — আমিই সময়কালে বিয়ের পরিবারের মত হলুম। তা সেকালের কর্তারা অত হিসেব-কিতেব বুঝতেন না, বললেন বিয়ে কর — এঁরাও অমন এ-কালের ছেলেদের মত মা-বাপের কথা ঠেলতে পারতেন না। আমার শ্বশুর বলতেন, যে আবাগের বেটী কোঁদল করবে, সে বাপের বাড়ী গিয়ে থাকুক — আমার বাড়ী তার ঠাঁই হবে না। তাঁদের দবন ছিল কত — কর্তা বাড়ীর ভেতর এলে আমরা কচিকাঁচা বৌ-ঝি ত ভয়ে কাঁটা হতুম — ঠাকরুণ সুদ্ধ ভয়ে সারা হতেন। একেলে মেয়েরা যেমন দিবা রাত্রি স্বামীর মুখোমুখি করে থাকে — জানিস কেষ্ট, আমাদের তা হবার জো ছিল না। রাত্রে সকল নিষুতি হলে তবে ঘরে কেউ দিয়ে আসত, তবে যেতুম। এক এক দিন বারান্দায়, কি দালানে ঘুমিয়ে পড়তুম — আর কেউ ঘরে যেতে বলতে যদি ভুলে যেত, তবে সেইখানেই রাত কাটত। রাধানাথ ছ-মাসের হলে তবে শাশুড়ী একদিন রাধানাথের বিছানা ঘরে দিলেন, সেই দিন থেকে যার যেদিন পালা পড়ত, সে সেই দিন ঘরে শুতে যেতুম। আমাদের ছেলে হলে ছ’মাস কর্তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাত্ করবার হুকুম থাকত না — তবে এদানী কিছু দরকার হলে কর্তা লুকিয়ে চুরিয়ে ভাঁড়ার ঘরে, কি রান্নাঘরে এসে বলে যেতেন। তা বাছা, আমরা দিনের বেলা কথা কইতুম না, শাশুড়ী টের পেলে গঞ্জনা সইতে হবে, এমন কথা নাই বা কইলুম। তা এ কালে সব রকমই আলাদা দেখে শুনে হাত পা পেটের মধ্য সেঁধিয়ে যাচ্ছে।”
মুখে অনর্গল বক্তৃতা চলিতেছে — হস্ত তৈলসমেত সর্বাঙ্গে সঞ্চালিত হইতেছে। ক্রমে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে অনেকগুলি রমণীমুখকমল ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। সকলেরই মন গৃহিণীর বক্তৃতার দিকে, সকলেই নিজ নিজ স্নান ভুলিয়া গিয়াছেন — কাহারও দাঁত মাজা আর শেষ হয় না, কেহ গামছা দিয়া গাত্র মর্দন করিয়াও তৃপ্ত হইতেছেন না। মূল কথা, মিত্রদের মেয়েটা হইয়াছে শুনিয়া সকলেই — তাই ত, আহা, মেয়েটা হল, বেটাছেলেটি হলেই সার্থক হত, বলিয়া আহা উহু করিতেছেন। একজন আশ্বাস দিয়া কহিলেন, “তা হোক, কত লোকের সাত মেয়ের পর ছেলে হয় — আমার পিসতুত বোনের সেদিন চার মেয়ের পর খোকাটি হয়েছে — খোকাটি এই ষেটের এক বছরের হল।”
এই রমণীমণ্ডলীর মধ্যে দু-একটি ঘোমটাবৃত যুবতী বধূ ও কন্যা স্নান করিতেছিল — একটি চতুর্দশবর্ষীয়া কন্যা আর থাকিতে পারিল না। মাতৃ সম্বোধনে কৃষ্ণদাসীকে কহিল, “তা মা, মামীর মেয়ে হয়েছে বলে তোমাদের দুঃখু রাখবার যেন ঠাঁই নেই, তাই ঘাটে এসেও সেই কাহিনী হচ্ছে — তা তুমি যা বল, আমার কিন্তু বাপু ঘোষদের কালো কালো ছেলের চেয়ে মামীর মেয়েদের বেশ ভাল লাগে — অমন একটা কালো ছেলের চেয়ে সাতটা সুন্দর মেয়ে ভাল। তোমাদের এক কথা, মেয়ে বুঝি কোন কাজে লাগে না ? তুমি এই যে আষাঢ় মাসে এখানে এসেছ, দু-তিন মাস যে করে দিদিমার সেবা করছ, মামা তেমন করে ? দিদিমাই ত দুঃখ করেন, আমার মেয়ে অসময়ে যত করে, ছেলে আমার তেমন করে না। তার বেলা বুঝি মেয়ের দরকার — এদিকে মেয়ে হয়েছে শুনলেই সর্বনাশ বাধে। এই যে ও বাড়ীর ছোট ঠাকুরমা — কাকা ত এক পয়সা আনতে পারেন না — যাই ক্ষেমা পিসি ছিলেন, তিনি খরচপত্র দিচ্ছেন, তবে কাকার সুদ্ধ চলছে। কিন্তু শুনেছি, ক্ষেমা পিসির আগে আর দু বোন হয়, তাই ওঁর নাম ক্ষেমা রেখেছিল।” এমন বিদ্রোহসূচক কথা শুনিয়া ঘাটসুদ্ধ সকলে অবাক হইয়া গেল। কাক আর ডাকে না, গাছের পাতা আর নড়ে না। গৃহিণী হাসিয়া কহিলেন, “ওলো পেরভা, থাম থাম, যখন তোর হবে, তখন বুঝবি — এখন ছেলেমানুষ কি বুঝবি — ছেলেমানুষের মুখে অত পাকা পাকা কথা ভাল শোনায় না।”
“তা ছোট ঠাকুরমা, সত্যি কথা বলছি — কেন এই ও-বাড়ীর ছোট মামীও বলছেন যে, ওঁর যদি মেয়ে হয়, তাতে কিছু দুঃখু হবে না। মামীও যে মেয়েদের কত ভালবাসেন, কেবল দিদিমার লাঞ্ছনার ভয়েই ত পাছে মেয়ে হয় বলে অত ভয় পান। মেয়ে হয়েছে, এখন ছেলে হবার সাধ হয়, দিদিমার ভয়ে মেয়েদের ভাল করে আদর পর্যন্ত করতে পারেন না। মামাবাবু ভয়ে পুজোর ভাল কাপড় অবধি করতে দিতে সাহস পেলেন না — নইলে মেয়েকে দিতে তাঁর ইচ্ছে হয় — কে জানে বাপু, তোমরা কি বোবা — তোমরা কি মেয়ে নও — ?”
“হ্যাঁগো গো জ্যাঠাইমা ঠাকরুণ, আমরা মেয়ে বটে, তা আমার কত আদর ছিল জানিস ? আমি মায়ের প্রথম সন্তান — দিদিমার আদুরে, ঠাকুরমার আদুরে — ঠাকুরমা বলতেন, ও কি আমার মেয়ে, ও আমার সাত বেটা, তা বলে বাপু গণ্ডা গণ্ডা মেয়ে হওয়া গৃহস্থের অলক্ষণ।”
ক্রমে প্রভার সমবয়স্কা আরও দু-চারটি কন্যা ঘাটে আসিয়া জুটিল। হরিদাসী কহিল, “কি ঠানদিদি, আজ যে ঘাট জাঁকিয়ে তুলেছ, ব্যাপারখানা কি ?”
“কি লো হরিদাসি, এসেছিস ? তাই ত বলি, তুই নইলে কি ঘাট মানায় ? আমরা বুড়ো মানুষ, আমরা আর ঘাট জাঁকাব কি, দুটো দুঃখের সুখের কথা কইছি বই ত নয়। তোদেরই এখন জাঁকের বয়েস — তাই বলছিলুম; বলি হরিদাসী যে এখনও এল না — কাল রাতে বুঝি নাতজামাই এসেছিল ?”
“সে আমি কি জানি ঠানদিদি, সে তোমরা জান। আমরা ঘাটে আসতে আসতে পথের ধারে হরকালী কাকার বাড়ী গেছলুম — তাদের খোকা হয়েছে দেখে এলুম; তাই আসতে একটু দেরি হল।”
“বটে! ওদের কেমন অদৃষ্ট দেখেছিস — এখন সময় ভাল, সব দিকে ভাল হয় — বৌয়েদের কেবলই বেটাছেলে হচ্ছে। আর ঘটাও তেমনি করে — এই আটকৌড়েতে হাঁড়ি করা রে — ষষ্ঠী পুজোয় তেল সন্দেশ দেওয়া রে — ভাতে বোগনো করা রে — খাওয়ানো রে, দাওয়ানো রে, সব করে। কেষ্টর মার যেমন অদৃষ্ট — একটা বৌ — কেবল গণ্ডা গণ্ডা মেয়ে হচ্ছে।”
হরিদাসী। “— তা হলই বা — মেয়ে বুঝি ফেলনা ?”
“ও বাবা! তোদের এ কালের যে সবই সমান দেখি — পেরভাও ঐ কথা নিয়ে কত মুখনাড়া দিলে — মেয়েছেলে আবার কোন কাজের গো ?”
“কোন কাজের নয় গো ? বাপ মা, স্বামী পুত্র, কারও অসুখ হোক, কারও অনটন হোক, মেয়েতে যত করে, এত কোন ছেলেতে করে গো ? মাকে মেয়ে যত যত্ন করে, মায়ের দুঃখ যত মেয়েতে বোঝে, এত কি ছেলেতে বোঝে ? ওগো, ওগো, স্ত্রীলোক হচ্ছে লক্ষ্মী — হাজার টাকাকড়ি থাক, দেখ, যে বাড়ীতে গৃহিণী নেই, সে ঘরকন্না কেমন বেশৃঙ্খল, যে ছেলেদের মা নেই, সে ছেলেপিলের কত অযত্ন! মেয়ে হয়েছে শুনেই তোমরা লাফিয়ে ওঠ, কি না বিয়ে দিতে হবে! তা বাপু, ছেলের জন্য কি কিছু খরচ নেই ? সেনেদের বাড়ী দেখতে পাই, ছেলেদের খাওয়া হলে তবে সেই পাতে মেয়েদের অমনি যা তা দিয়ে খেতে দেয়। ছেলেদের জুতো জামা, সাফ কাপড়, মেয়েদের ময়লা পাঁচী ধুতি। ছেলেদের দু পয়সা করে এক এক জনের খাবার বরাদ্দ, মেয়েদের এক পয়সার আটার রুটি করে তিন চারটিকে দেয়। ছেলেরা ভাল গদিতে খাটে শোয় — মেয়েগুলি মেঝেতে মাদুরে একটা ছেঁড়া লেপ পেতে শোয়। বড় বড় ছেলেরাও মা বাপের সঙ্গে শুতে পায়, ছোট বোন দুটি রাঁধুনীর কাছে শোয়। — আহা, তাদের যদি একটু যত্ন আছে! সেদিন ও বাড়ীর মেজ কাকীর মেয়ে মামার বাড়ী থেকে বাড়ী এসেছে, ঠাকুরমার কাছে সকালে ভাত চেয়েছে, তখনও কেউ খায়নি বলে ঠাকুরমা স্বচ্ছন্দে তাকে বললে কিনা, মেয়েমানুষ আগ দোফের ভাত খাবে কি! এখনও কেউ খায়নি, আগে আগে ভাত দাও! আগে বাপ খুড়ো খাগ, তবে সে পাতে খাস। আহা, সে ছ-সাত বত্সরের মেয়ে, অত কি জানে, ভাতের জন্য কাঁদতে লাগল, শাশুড়ির ব্যাভার দেখে মেজ কাকীমা রাগ করে তখনই তাকে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিলে। আমাদের কাছে কত দুঃখু করতে লাগল যে, বাছা একদিন বাড়ী এল, দুটো ভাতের জন্যে কেঁদে চলে গেল। এ কি মায়ের প্রাণে সয়! তা কে জানে, মেয়ে আদরের না অনাদরের!”
“বাবা, এ-কালের মেয়েগুলোর মুখের তোড় দেখ, যেন ঝড় বয়ে গেল, যা যা, আর জলে পড়ে থাকিস নে, অসুখ হবে।”
যাহা হউক, অল্পবয়স্কারা আর অধিক উত্তর প্রত্যুত্তর করিল না। তাহারা স্নান সমাপনান্তে গৃহে চলিয়া গেল। সকলেই আসিতেছে, অল্পবিস্তর শুনিয়া চলিয়া যাইতেছে, কিন্তু পুষ্করিণী - অধিকারিণীর সেই তৈলমর্দনই চলিতেছে। এমন সময় ব্যস্ত সমস্ত হইয়া হরকালীর মায়ের প্রবেশ — কি ব্যাপার! — ইনি ভারি ব্যস্ত — ইঁহারই গৃহে কাল শাঁখ বাজিয়াছে — বধূর পুত্রসন্তান হইয়াছে।
“এ কি — ঠাকুরঝি যে, আজ গঙ্গা নাইতে যাসনি ? আমি বলি, আজ কেবল আমারই যাওয়া হয় নি — তা বোন, কি করি, মেজ বৌমার কাল রাত্রে বেটাছেলেটি হল — তা ফেলে যাই কি করে ? জানিস ত, এ কালের মেয়েগুলো সব বিবি হয়েছে — তাপ সেঁক নেবে না, ঝাল খাবে না। আমি তেমন মেয়ে নই — ঐ জন্যে বৌয়েদের কখন প্রসবকালে বাপের বাড়ী পাঠাই না। সেজ বৌয়ের বাপ আবার ডাক্তার, তিনি তাপ নিতে দেবেন না, ঝাল খেতে দেবেন না — মেয়েকে গদি পেতে শোয়াতে চান। জান ঠাকুরঝি, আমাদের যেমন নিয়ম আছে, ডাক্তার বলেন, ও সব ফেলে দাও — আমি তেমন মেয়ে নই - এই বসে বৌকে ভাজা ভাজা করে তাপ দিয়ে এলুম, এইবার নেয়ে গিয়ে ঝাল খেতে দেব। ডাক্তার আছেন, তিনি আছেন, — তাঁর মেয়ে ঘরে এনে কি আমি নিয়মভঙ্গ করব। সে বার আঁতুড়ে সেজ বৌয়ের মেয়েটা গেল, ডাক্তার দেখতে এসে বললেন, এই সব স্যাঁতানে জায়গায় পড়ে ব্যায়ারাম হয়েছে, — বলে আঁতুড় নাড়তে চান — আমি তা কিছুতে করতে দিই নি।”
“সে মেয়েটার কই কি ব্যায়ারাম হয়েছিল, আমি ত শুনি নি — তাঁর উপর না সেই বাবার দৃষ্টি পড়েছিল ?”
“তাই ত বলছি ভাই — ওঁরা বড় বোঝেন, শিশি শিশি ওষুধ এল, গেলাতে চান — গিলবে কে ? — বাবা মুখ চেপে ধরে আছেন — সে জ্ঞান নেই। ও রোগের যা, রোজা এনে সব করলুম, তা কিছু হল না। হবে কি — রোজা বললে যে, পোয়াতি চাঁপাফুলের গাছের নীচে গেছল — তাই দৃষ্টি পড়েছে। সাহেবের মেয়ে, বেটী হয়ত কোন গাছতলায় মাছতলায় গেছল, ও সব ত মানা হয় না। এবার আমি আর বাপের বাড়ীমুখো হতে দিই নি। সেবার যেন মেয়েটা গেল গেল, কিছু ক্ষতি হল না — এবার বেটাছেলেটি হয়েছে, একটু ভাল করে তাপ সেঁক না দিলে কি হয় ? পোয়াতি ভাল থাকলে, তবে ছেলের পিত্তেশ — কি বলিস ভাই ?”
“তা বই কি, বংশ রক্ষার জন্য বৌয়ের আদর, নইলে পরের মেয়ে ঘরে এনে জঞ্জাল বই ত নয়। তা হোক, বেটাছেলেটি হয়েছে — আটকৌড়েতে হাঁড়ি করিস। তোদের সূতিকাপুজো আছে ত ?”
“হ্যাঁ, সূতিকাপুজো হবে বই কি — তা লক্ষ বামনের পায়ের ধুলো কোথায় পাব, — বারোটি বামনের পায়ের ধুলো দেব — আর পূজা আশ্রয় সব হবে। আটকৌড়ে যেমন আর সব বৌয়ের ছেলেদের বেলা করেছি, এরও তেমনি হবে — এক হাঁড়ি জলপান, একটি করে সিকি, চারটে করে মেঠাই, এই সব ঘরে ঘরে দেব — আর বাড়ীতে ছেলেরা যারা আসবে, তাদের বেটাছেলেদের দু আনা, মেয়েদের চার পয়সা করে দেব। আর বেঁচেবত্তে থাকে ত ভাতটিও দিতে হবে। যেমন বেটাছেলেটি হয়েছে আহলাদের, তেমনি খরচপত্রও হবে। এই ধাইকে নগদ এক টাকা, একটা ঘড়া কালই দিতে হল — আবার আসবে বিদেয় নিতে। মেয়ে হলে, সেই যা নাড়ীকাটা একটা টাকা ধার আছে — আর কি!”
“তা পরমেশ্বর দিন দিয়েছেন, আমোদ আহলাদ খরচপত্র করবি বই কি! আমার দু মেয়ে এখানে আছে, আমার ঘরে তিনটে হাঁড়ি দিস, আর আমার সতীন-পো বৌও ভিন্ন হয়েছে।”
“হ্যাঁ ভাই, তা বললে ভাল। এই বাড়ী গিয়ে হাঁড়ির ফর্দ করতে হবে। আবার বাজনা আসবে, তবে নাচ আসবে, তার বিদায় খরচ ঢের” —
“শুনেছিস, মিত্তিরদের বৌয়ের আবার মেয়ে হয়েছে!”
“ও মা, বলিস কি, আবার মেয়ে — কে বললে ?”
“এই কেষ্ট রাত থাকতে এসেছিল, আঁতুড় ছুঁয়েছিল কিনা, সেই কত দুঃখ খেদ করতে লাগল — তারই সঙ্গে কথায় কথায় জাহ্নবী নাইতে যাওয়া হল না — আমি ভোরে কাপড় কাচতে এসেছি, আর কেষ্ট এল।”
“হ্যাঁ ঠাকুরঝি, গঙ্গা তোমার কার নাম গা ?”
“আমার ছোট খুড় শাশুড়ীর নাম ফঙ্গামণি, তাই আমরা জাহ্নবী বলি — ঠাকুরদের নাম আমাদের প্রায় করবার জো নেই। আমাদের বৃহত্ পরিবার, সকল নাম বেছে চলতে হয় ত — আমরা ত একেলে নই যে, সুদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ীর নামটি হদ্দ মেরে কেটে বাছব।”
“তাই ত ঠাকুরঝি, মিত্তিরদের বৌটো কি গা — এবার গোটা চার পাঁচ মেয়ে হল বুঝি — আমার বড় বৌমার ষেটের কোলে এই দুটি; দুটি নষ্ট হয়েছে; তাই শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে মেজ বৌমারও দুটি বেটা, একটা মেয়ে, তা মেয়েটা মামার বাড়ী থাকে, দিদিমার আদুরে, মেজ বৌমা বাপের একটি মেয়ে কি না তা ঐ প্রথম মেয়ে দিদিমাই মানুষ করেছে, সে মেয়ের ভার আর আমাদের নিতে হবে না — দিদিমা তাকে হাতের তেলোয় আর নাচিয়ে নাচিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, বেটাছেলে করে কাপড় পরানো হয়, হেমন্তকুমারী নাম, তা হেমবাবু বলে ডাকা হয়। সে মেয়ের আদিখ্যেতা কত। আর সেজ বৌয়ের দুটো মেয়ের একটা সেই আঁতুড়ে গেছে, আর এই খোকাটি হয়েছে।”
“তা বেঁচে থাক, আমরা সব পাঁচ কম্র্মে যাব, খাব, নেব। আমাদের ঘরের কথা। মেয়েগুলো কেবল মিথ্যা বই ত নয়। সূতিকাপুজো নেই, আটকড়াই কর আর না কর, ভাত — তা বড় সাধ হয় ত পাঁচজনকে এনে খাওয়াও। একটু কেবল পেসাদ মুখে দেওয়া, তার ক্রিয়া নেই কম্র্ম নেই, পিতৃপুরুষ এক গণ্ডুষ জল পায় না। ঐ যা বিয়ের সময় একবার পিতৃপুরুষ জল পান বই ত নয়।”
“যাই, এই বেলা বাড়ী যাই; সেজ বৌয়ের বাপ হয়ত এসে এতক্ষণ কত হাঙ্গামা করছে। ছেলেরা ছেলেমানুষ, তারা ত কথা কইতে বড় পারে না — আমি এমন জবরদস্তি না হলে রক্ষা ছিল! আর ছেলেগুলোরও ঐ মত — সব একেলে কিনা। তা আমার উপর বড় কথা কয় না, বেশী বললেই আমি বলি যে, এখন বড় হয়েছিস, আমায় মানবি কেন ? আমি তোদের চারটি নিয়ে বিধবা হয়ে কত কষ্ট করে তোদের এত বড় করলুম, এখন আমি পর হলুম, শ্বশুরই আপনার হল। তা ওরা আর কথা কইতে পারে না। এই ছোট ছেলে - ঐ একটু মুখেফোঁড় — আর কোলের কিনা, আদুরে — ওকে কিছু বলতে পারি নে, ও আঁতুড়ে মাতুড় ছুঁয়ে নেপে সৃষ্টি করে। এই আঁতুড় উঠবে আর বৌগুলোকে দিয়ে নেপ বালিশ পর্যন্ত সব কাচিয়ে নেব।”
“ও সব আর বলিস নে - জাত জন্ম আর রইল না। এ কালের ছেলে, ওরা সব এক রকম। আমার ছোট জামাই অমনি, সে বার বিধু প্রসব হতে এখানে এসেছিল, জামাই রোজ দেখতে আসত, সেই বিছানায় বসে গল্পসল্প করে চলে যেত। প্রথম যে দিন এল — আমি তখন নাইতে গেছি — মালা হাতে করে দাঁড়িয়েছি, আর আঁতুড় থেকে বেরিয়ে খপ করে পায়ের ধুলো নিলে। কি করব, বললুম — ‘বাবা, আঁতুড় ছুঁয়ে কি আমায় ছুঁতে আছে ? আবার হাতে মালা।’ তা অপ্রস্তুত হয়ে বলে, ‘আমার অত মনে ছিল না।’ আমি আর কি করব — মালা গেল, আবার পুকুরে নেয়ে মরি। তা জামাইয়ের যে মত, মেয়েকে সেই মতেই রাখতে হয় — আমি লুকিয়ে দুটো দুটো গুঁড়ো ঝাল দিই — মেয়েগুলোও তেমনি, হাত পেতে নিলে, কতক খেলে, কতক বা না খেলে, — বলে, ‘ঝাল খেলে মা কেবল জলতেষ্টা বাড়ে বই ত নয়, তোমরা ত জল দেবে না — সুদ্ধ সাবু খেয়ে থাকলে তেষ্টাও হয় না, জলও চাই না।’ কে জানে ভাই, ওদের কেমন কথা। আঁতুড়ে তেষ্টা পায় না — আমাদের এমনি তেষ্টা ছিল যে, অতি ময়লা জলও এক কোষ চুরি করে খেয়েছি। আমাদের কালে ঝাল দিয়ে সুদ্ধ মুখ ধুতে জল দিত। তাতে কি প্রাণ বাঁচে!”
“তা বই কি, আমার এই চারটি গুঁড়ো হয়েছে, ফি বারই আঁতুড়ে মাগীকে পয়সা দিয়ে পায়ে হাতে ধরে জল চুরি করে খেয়েছি। এদিকে ভাজা ভাজা তাপ, ওদিকে সরা সরা ঝাল — যেমন তেষ্টা, তেমনি গা’র জ্বালা — ওতেই ত শরীর ঝনঝনে হয়। ঐ গো, বাজনা এসেছে, তবে আজ আসি।” বলিয়া গামছা নিংড়াইতে নিংড়াইতে ভিজা কাপড়ের অঞ্চল স্কন্ধে ফেলিয়া প্রস্থান।
গৃহিণী। “দেখেছিস গয়লা বৌ, হরকালীর মায়ের তেজ দেখেছিস! অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়ে না, আপনার চার ছেলে বলে কেবল জানানো হয় আমার চারটি গুঁড়ো। যমের জ্বালা ভুগতে হয় নি, তাই অত জাঁক — ছেলে হলেই ত হয় না। বাঁচাই মূল। যমে না সর্ব্বনাশ করলে আমিও আজ রাজার মা।”
গয়লা বৌ —। “তা বই কি মা ঠাকরুণ, যমের জ্বালা বড় জ্বালা। আমার দু ছেলে দু মেয়ে যমকে দিয়েছি, এখন দুটি মেয়ে একটি ছেলে নিয়ে প্রাণ ধরে আছি - বড়টি শ্বশুরবাড়ী গেছে; মা, কেঁদে কেঁদে মরছি। মা, আমরা দুঃখী মানুষ, তা বাছারা আমার এমন যে, আমার পয়সা নেই, কেমন বোঝে — পাছে চাইলে না দিতে পারি, তাই এত সোনার সামগ্রী পাড়ায় আছে, কখনও খেতে কিনতে চায় না।”
গৃহিণী। “তোর মেয়েটি না বেশ ভাগ্যিমন্তের ঘরে পড়েছে?
গয়লা বৌ। “হ্যাঁ মা, তোমার আশীর্বাদে তারা বড় ভাগ্যিমন্ত, আর আমার নয়নতারাকে খুব যত্ন করে। কিন্তু তা হলে কি মায়ের মন বোঝে — আমি যে সকালে এক পয়সার মুড়ি, তিনজনকে দিতে পারি না, তাতে যে আমার বুক ফেটে যায়।”
গৃহিণী। “তা কি করবি, কাঁদিস নে, চুপ কর। মেয়েজন্ম পরের ঘরে যাবার জন্যেই হয়েছে। তাই ত বলি গয়লা বৌ, মেয়েগুলো মিথ্যা। দু দিন বাদে পরের ঘর যাবে — তা বলে এ কালের মেয়েদের কাছে তা বলবার জো নেই।”
গয়লা বৌ। “তা মা, দু দিন বাদে শ্বশুরবাড়ী যাবে বলেই ত আমার প্রাণ কেমন করে। তা জন্যেই ত মা, আমি মেয়ে দুটিকে না দেখে থাকতে পারি নে। বেটাছেলে মা, বেঁচে থাকলে ওরা আপনারা আনবে নেবে, বৌ হবে, আদর যত্ন চিরদিন পাবে — আমার প্রাণ ঠাণ্ডা থাকবে। মেয়েদের মা না করলে আর কে করবে? শাশুড়ী ননদ অত করবে না — দু দিন বাদে মেয়েরা আবার মা হবে — আপনার ছানাপোনা নিয়েই ব্যস্ত হবে। আজ যদি মা আমি না আদর করি ত কে আর তাদের আদর করবে?”
গৃহিণী। “তা বই কি! তোর ঢের গেছে কি না, তাই তোর বেশী মায়া — নইলে জগত্ জুড়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের আদর কম। ছেলেটি হয়েছে বলতে দশ হাত বুক হয় — শুনতে কেমন। ঘটাঘটি আমোদ আহলাদ হয়। সাত ছেলে হলেও অরুচি নেই। মেয়ে প্রথম হলে, লোকে বলে, তা হউক — এইবার ছেলে হবে। প্রথম যা হয়েছে, বেঁচে থাক — জেঁয়াচ বজায় থাকলে তবে ত মঙ্গল। তবে ত ছেলের পিত্তেশ।”
গয়লা বৌ। “হ্যাঁ মা, যাই — বেলা হল।”
ক্রমে ঘাট শূন্য হইয়া আসিল, স্বপ্নময় মোহমুগ্ধ নয়নে আসিয়াছিলাম, সত্যের তীব্রতা লইয়া ফিরিলাম। প্রকৃতি জননীর আর সেই মধুর স্নেহময় ভাব নাই — এখন চারিদিকে কর্তব্যের ঘোর শাসনকর্তব্য লইয়া সকলে ছুটাছুটি করিতেছে। নয়নে আর সেই মোহ নাই — সূর্যালোকে সকলই পরিষ্কার স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। মনে জাগিতেছে আদরের, না অনাদরের! স্নেহেও পক্ষপাতিতা আছে — শুধু স্নেহে নহে — মাতৃস্নেহও আছে — মাতাও কন্যা অপেক্ষা পুত্রকে অধিক স্নেহ ও যত্ন করিয়া থাকেন। ভাবিতে ভাবিতে শয্যাসম্মুখে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম, আমার সে ফুলটি এখনও ফুটিয়া উঠে নাই — আমার চুম্বনের সূর্যালোকে এখনও সে ফুল স্পর্শ করে নাই, তাই এখনও সে ফোটে নাই — নিঃশঙ্ক সুষুপ্ত মুখে যেন লেখা রহিয়াছে পড়িলাম —
“অনুগ্রহ করে এই করো, অনুগ্রহ করো না এ জনে।”
আমি তাহাকে চুম্বন করিলাম — হাসিয়া আঁখি মেলিয়া সে আমার মুখের পানে চাহিল। আমি বুকে টানিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম — মা আমার, তুমি আদরের না অনাদরের?
— আমি আদরের!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন