বাপের বয়সী হলেও পাড়ার সব ছেলেরাই তাকে বড়দা বলে ডাকত। এর কারণ হচ্ছে বড়দার যে সবচেয়ে ছোট ভাই, সে ছিল আমাদের দাদাদের সমবয়সী ও বন্ধু। দাদারা তাকে বড়দা বলত আর সেই সূত্রে পাড়ার সব ছোটদেরই ছিল সে বড়দা।
বড়দা ছিল বড়লোকের ছেলে। বাপের বড় কারবার, কলকাতায় বারো-চোদ্দখানা বাড়ি, তাছাড়া নগদ টাকা, গাড়ি-ঘোড়া, জমজমে সংসারের বড় ছেলে সে—খুব সমারোহেই তার দিন কাটত।
ছেলেবেলায় বাপ তাকে বিদ্যেসাগর মশায়ের ইসকুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। গাড়ি চড়ে সেজেগুজে সে ইসকুলে যাওয়া-আসা করত বটে, কিন্তু সরস্বতীর সঙ্গে সদ্ভাব আর কোন দিনই হল না। বড়দার ছোট ভাইরা অর্থাৎ মেজদা সেজদার দল যখন এনট্রেন্স পাস করে গেল, সে তখনও চতুর্থ শ্রেণীর গণ্ডি উত্তীর্ণ হতে পারলে না দেখে তার বাবা ইস্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলেন।
বড়দার বাবা ছিলেন বড় ব্যবসায়ী, এজন্য তখনকার ইংরেজ সওদাগর-মহলে তাঁর বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। তিনি এদের একজনকে ধরে তাঁর আপিসে বড়দাকে ষাট টাকা মাইনেতে ঢুকিয়ে দিলেন। তখনকার দিনে যাট টাকা মাইনেকে মোটা মাইনে বলে বিবেচনা করা হত। বড় বড় ঘাগী কেরানীরা সারাজীবন চাকরি করে শেষবয়সে ষাটের কোঠায় পৌঁছত। বড়দার বরাত ছিল ভালো, কুড়ি বছর বয়স হবার আগেই তার ষাট টাকা মাইনে হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, বুদ্ধি-বিবেচনা খরচ করে কাজ করলে সেই ষাট যে ভবিষ্যতে ষাট হাজারে পরিণত হবার সম্ভাবনা ছিল, এমন কথাও বড়দার মুখে আমরা শুনেছি।
বিদ্যার প্রতি অনুরাগ না থাকলেও বিদ্যোধরীদের প্রতি বড়দার আকর্ষণ ছিল সহজাত। চাকরি হবার সঙ্গে সঙ্গে সেই আকর্ষণ প্রবল হয়ে উঠল। তখনকার দিনে বড়লোকদের ছেলেদের পক্ষে যদিও সেটা মারাত্মক দোষ বলে বিবেচিত হত না, তবুও বড়দার বাবা ছেলের হালচাল দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। কারণ, সেই বয়সেই তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল এবং তখন সে এক ছেলের বাপ।
বড়দার বাবা ভেবেচিন্তে একটা উপায় আবিষ্কার করলেন। একদিন তিনি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে মোটারকম একটা জীবনবীমা করিয়ে দিলেন। বন্দোবস্ত হল, মাসের প্রথমেই বড়দার মাইনের টাকাটা আপিস থেকেই সোজা জীবনবীমা আপিসে চলে যাবে। এ ব্যবস্থাটা অবশ্য গোপনেই হয়েছিল, বড়দা আগে কিছুই টের পায় নি।
কিন্তু মাস শেষ হতেই গোল বাধল। নির্দিষ্ট দিনে মাইনে নিতে গিয়ে বড়দা যখন শুনলে সে অর্থ অন্যত্র চলে গেছে, তখন সে হাঁ না কোন কথা বললে না—শুধু পরের দিন থেকে আপিসে যাওয়া বন্ধ করে দিলে। দিন-পনের বাদে আপিস থেকে সংবাদ পেয়ে বড়দার বাবা একদিন তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন—আপিসে যাচ্ছ না কেন?
বড়দা বললো—আজ্ঞে, আপিসে গিয়ে কি হবে। মাইনে যখন পাওয়া যাবে না—
—তোমার জীবনবীমা করা হয়েছে। পঁচিশ বছর পরে পঁচিশ হাজার টাকা পাবে তুমি, সেটা ভুলো না। বছরখানেক বাদে তোমাকে ওরা একশ' টাকা দেবে বলেছে, তখন চল্লিশ টাকা থাকবে তোমার হাতে। ইতিমধ্যে হাতখরচের জন্যে দু-পাঁচ টাকা যা দরকার আমার কাছ থেকে চেয়ে নিও। কাল থেকে আপিসে যাও—ছেলেমানুষি করবার বয়স নেই তোমার। এখন ছেলেপূলের বাপ হয়েছ, বিবেচনা করে কাজ করতে শেখো।
কিন্তু বড়দা আর আপিসে গেল না। জীবনবীমার মাসিক দেয় প্রতি মাসে তার বাবাই যুগিয়ে যেতে লাগলেন।
বড় ছেলের ওপর বাপ কোনকালেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, এই ব্যাপারের পর তিনি একেবারে তার ওপর হাড়ে চটে গেলেন। বড়দা সে সব গ্রাহ্য না করে হৈ হৈ করে পাড়ার অল্পবয়সী ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়াতে লাগল। বাপের সঙ্গে তার দেখাই হত না, যতক্ষণ সে বাড়িতে থাকত অথবা তার বাবা বাড়িতে থাকতেন, ততক্ষণ সে বার-বাড়িতে আসতই না। বাড়ির ভেতরে ঠাকুরমা ও মার সঙ্গে সেদিনকার খাওয়া-দাওয়ার পরামর্শ করত। প্রায় সারাদিনই নানা রকমের খাওয়া-দাওয়া ও তার বন্দোবস্ত করতেই কেটে যেত। রাত্ৰিবেলা আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরে পরিতোষপূর্বক আহার করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ত। তখনি সে দু ছেলের বাপ, বয়স কুড়ি পেরোয় নি।
এই সময় অকস্মাৎ কলেরা হয়ে দুদিনের তফাতে বড়দার স্ত্রী ও মা মারা গেলেন। মা ও স্ত্রীর শোকে বড়দা নাকি সাতদিন না খেয়ে দরজা বন্ধ করে পড়ে ছিল। দরজা ভেঙে যখন তাকে বের করা হল, তখন সে মৃতপ্রায়। কলকাতার সেরা সেরা ডাক্তারের চিকিৎসায় সে প্রায় এক বছর পরে সেরে উঠল।
এসব ঘটনা আমরা জন্মাবার আগেই হয়ে গিয়েছিল।
এই রোগের পর বড়দার হালচাল একেবারে বদলে গেল। আটহাতি ধুতি আর এক জোড়া চটি এই হল তার পোশাক। আহার এবং বচনে জিহ্বার সংযম গেল একেবারে উড়ে, যার-তার সামনে যা-তা কথা বলতে আরম্ভ করে দিলে। বাস্তব রাজ্য ছেড়ে সে কল্পলোকে পক্ষবিস্তার করল। কোথাও সে নেমন্তনে যেত না, বাড়িতে বাইরের কোন লোক, এমনকি চেনা লোক পর্যন্ত এলে সামনে বেরুত না। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নাচতে নাচতে ঠাকুরমার কাছে গিয়ে সেদিনকার দ্বিপ্রাহরিক আহারের একটা ফিরিস্তি দিয়ে সে পাড়ায় ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বেরুত। বেলা বারোটার সময় বাড়ি ফিরে আহারাদি শেষ করে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিত।
ডাক্তারেরা দুপুরবেলা তাকে ঘুমুতে বারণ করে দিয়েছিলেন, তাই দুপুরে জেগে থাকবার একটা উপায় বড়দা আবিষ্কার করেছিল। ঘরে ঢুকে বেশ করে দরজা বন্ধ করে সে চীৎকার করত—দরোয়ান।
কাল্পনিক দরোয়ান এসে দাঁড়াল। বড়দাই বললেন—হুজুর।
—গাড়ি জুততে বলো, লাটসাহেবের বাড়ি যাব।
তারপর খানসামা এল কাপড়াচোপড় পরাতে। এ পোশাক নয়, ঐটে দে—সেদিন লাটসাহেব জিজ্ঞাসা করছিল এটা কোন দরজির তৈরি ইত্যাদি। পোশাক বাছতেই আধা ঘণ্টা কেটে গেল। তার পরে গাড়ি এল, এ-রাস্তা সে-রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলেছে—বড়দাই গাড়ি, বড়দাই ঘোড়া, কোচোয়ান, সহিস, মনিব সবই সে। কখনো কোচোয়ানকে ডেকে ধমক লাগানো হচ্ছে—এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছ কেন, আমি কারুর বাপের চাকর নই। এই করে লাটসাহেবের বাড়ি গিয়ে পৌঁছনো হল। তার আগমনে তারা তো সন্ত্রস্ত। আজ তো আপনার আসবার কথা নয়—বিশেষ একটা কাজে এসেছি ইত্যাদি।
এই করে পাঁচটা অবধি কাটিয়ে আবার নাচতে নাচতে ঠাকুরমার কাছে গিয়ে রাত্রের আহারের ফিরিস্তি দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ত আড্ডা দিতে।
রোজই যে লাটসাহেবের বাড়ি যেতে হবে তা নয়, কোন দিন বিরাট প্রাসাদ তৈরি হত, কোন দিন বা বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন—প্রত্যহ দ্বিপ্রহরটা তার এই করেই কাটত।
এইভাবে বড়দার দিন কাটে। ছেলেদের দল বড় হয়, বড়দা বাপের দল ছেড়ে আবার ছেলেদের দলে ঢোকে। এই রকমে প্রায় তিন দল ছেলে পার করবার পর বড়দার সঙ্গে আমাদের ভাব হল।
পাড়ার একজনদের বাড়িতে একটা চওড়া রোয়াক ছিল। এই রোয়াকের ওপর রবিবার ও অন্যান্য ছুটির দিন ছেলেদের নিয়মিত আড্ডা বসত, আর সেখানে বড়দা কখনো অনুপস্থিত থাকত না।
বড়দার সঙ্গে যখন আমাদের ভাব জমল, তখন আমাদের বয়স তেরো থেকে সতেরো আর বড়দার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বৃদ্ধ বাপ ও ঠাকুরমা তখনো বেঁচে। আটহাতি ধুতি ছেড়ে তিনি তখন দশহাতি ধুতি পরতে আরম্ভ করেছেন, যদিও তাঁর লম্বাচওড়া চেহারায় দশ হাত ধুতিও ছোট হয়। খালি গায়ে অসভ্যর মতন এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায় দেখে ভাইয়েরা তাকে বাউলদের মতন কৌপিন ধরনের জামা তৈরি করে দিয়েছে—তাই গায়ে দিয়ে সে রাস্তায় বেরোয়।
ছেলেদের আড্ডায় তখন দেশোদ্ধার, কুস্তি, খেলা, ইংলণ্ড, জার্মানি, সুইজারল্যাণ্ড প্রভৃতি সব রকমের কথাই আলোচনা হয়—বড়দা তার মধ্যে প্রধান বক্তা। সব বিষয়ের সব কথা সে জানে। ইউরোপ আমেরিকার কথা উঠলে সে এমন ভাব দেখায় যেন সারাজীবন সেখানেই তার কেটেছে। আমি তখন একটা মিশনারি ইস্কুলে পড়তুম। একদিন বাইবেল সম্বন্ধে কথা উঠতেই বড়দা বললেন—বাইবেল খুব ভাল বই। বাইবেল পড়লে খুব ভাল ইংরেজি শেখা যায়।
একজন জিজ্ঞাসা করলে—বড়দা, বাইবেল পড়েছেন?
—বাইবেল পড়িনি, বলিস কি! ইস্কুলে ফি বছরে বাইবেলে ফাস্ট হতুম বলে আমায় মেডেল দিয়েছিল।
আমাদের চাপা হাসি, এমনকি উচ্চহাসি পর্যন্তও মাঝে মাঝে বড়দা উপেক্ষা করত। বাইবেল গ্রন্থে বড়দার এতাদৃশ জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে আমরা হেসে উঠতেই সে বললে—জানিস, একদিন ডফ সায়েব আমাকে ডেকে বললে—আমি শুনেছি তুমি খুব ভাল বাইবেল জান। আচ্ছা, আমি যদি বাইবেল থেকে তোমাকে কোনো প্রশ্ন করি তো ঠিক উত্তর দিতে পারবে?
আমি বললুম—পারব স্যর।
সায়েব বললে— আচ্ছা বলো তো, How many commas and semi-colons in the Old Testament.
প্রশ্ন শুনেই ঝড়াকসে বলে দিলুম। ডফ সায়েব তো অবাক! আমাকে ঠকাবার জন্য প্রশ্ন করেছিল বটে, কিন্তু সে নিজেই জানত না। শেষকালে তিনটে কেরানী ডাকিয়ে old Testament-এর comma আর semi-colon গোনাতে আরম্ভ করে দিলে। শেষকালে দেখা গেল, আমার উত্তর ঠিক হয়েছে। তাতেই তো মেডেল দিলে—বাবা, সাদা চামড়া ওমনি ভোলে না।
বাড়িতে একমাত্র রান্নাঘর, নিজের শোবার ঘর, পাচকঠাকুর, ঠাকুরমা আর খাস চাকর ভোলানাথ ছাড়া আর কারুর সঙ্গে সে বড় একটা কথাবার্তা বলত না। অধিকাংশ লোককে সে চিনতই না। তার ভাইদের ছেলেমেয়ে, তাদের ও নিজের নাতিনাতনীদেরও সবাইকে সে চিনত না। বাড়ির আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতদের মুখ সে একরকম ভুলেই গিয়েছিল।
বড়দাদের বাড়িতে খুব সমারোহ করে দুর্গাপুজো হত। পাড়ার ছেলেবুড়ো তিন-চার দিন দিবারাত্র তাদের বাড়িতে সে সময় আড্ডা জমাত। বাড়ির সকলেই ব্যস্ত নিমন্ত্রিতদের আদর-আপ্যায়ন, খাওয়া-দাওয়া নিয়ে, ছোটরাও দম ফেলবার অবকাশ পায় না। বড়দা কিন্তু নির্বিকার! সে আমাদের সঙ্গে একটা ঘরে বসে সমানে আড্ডা দিচ্ছে। নবমীর দিন থিয়েটার হবে—অমর দত্ত ভাল অভিনয় করে কি দানী ঘোষ ভাল অভিনয় করে, এই নিয়ে তুমুল তর্ক চালিয়েছে। বলা বাহুল্য এই দুজনের একজনকেও সে দেখেনি। তর্কে তার সঙ্গে কোনো দিন কেউ পেরে উঠত না। হেরে যাবার উপক্রম দেখলেই বড়দা বলত—তোরা কি জানিস, কালকের ছোঁড়া তোরা!
তাতেও আমরা না দমলে গালাগালি দিতে দিতে সে উঠে যেত—আর সে যাচ্ছেতাই গালাগালি। একবার পুজোর সময় আমরা ষড়যন্ত্র করলুম বড়দাকে জব্দ করতে হবে। বড়দার বাবা ছিলেন শৌখিন লোক। তিনি এই সময় কাশী লক্ষ্নৌ প্রভৃতি জায়গা থেকে ভাল ভাল নামজাদা সানাই-বাজিয়ে নিয়ে আসতেন। অবিশ্যি কলকাতার হাড়িপাড়া থেকেও সানাই-বাজিয়ে আসত, তবে সে সময় তারা বিশেষ পাত্তা পেত না।
সেবারে বোধনের দিন থেকেই আমরা বড়দাকে আক্রমণ শুরু করে দিলুম—আপনাকে, কেউ গ্রাহ্য করে না; বাড়ির লোকেরা তো নয়ই এমনকি নিমন্ত্রিতেরা পর্যন্ত নয়। কেউ চেনেই না আপনাকে—সবাই মনে করে লোকটা চাকর-বাকর ক্লাসের কেউ হবে।
বেশ বুঝতে পারা গেল বড়দা মনে মনে গরম হচ্ছে। কারণ, তখন থেকেই সে চাকর-বাকিরদের ধমক ধামক, ভাইদের নানারকম ফরমায়েস করতে শুরু করে দিলে—আমাদের দেখাবার জন্য।
সন্ধ্যেবেলা গিয়ে দেখলুম বড়দা একটা পরিষ্কার আলখাল্লা পরে বাড়িময় পা ঘষে-ঘষে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুখে তার ভয়ানক ব্যস্ত-ভাব। আমাদের দেখে বললে—এই যে এসেছিস, বোস বোস, আমার কি ভাই মরবার সময় আছে—বোস গিয়ে তোরা, আমি আসছি।
আমরা ঘরে গিয়ে বসতে না বসতে বড়দা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির৷ বললে—ওঃ; সকাল থেকে খাটতে খাটতে মরে গেলুম। বাড়িতে এত লোক, কিন্তু আমি না দেখলে কোন কাজ কি হবার জো আছে, ইত্যাদি—বলে বেশ একটা জমাট আবহাওয়া করে তুলেছে, এমন সময় আমাদেরই দলের একজন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললে—এই যে বড়দা, এখানে দিব্যি বসে আছেন, আর ওদিকে ধূমধাড়াক্কার মহারাজা সায়েব না খেয়ে চলে যাচ্ছেন।
বলা বাহুল্য, এসব আমাদের আগে থাকতেই ঠিক করা ছিল।
কথাটা শুনেই বড়দার মুখখানা যেন কি রকম হয়ে গেল। কিন্তু পাছে তার মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক হয়, সেজন্য আমরা বলে উঠলুম—ওঃ, ধূমধাড়াক্কার মহারাজা না খেয়ে চলে গেলে বড় কেলেঙ্কারি হবে। বড়দা যান, যান—
বড়দা আর দ্বিরুক্তি না করে উঠে-পড়ে বলতে লাগল—দেখ দিকিন, বাড়িতে কি আমি ছাড়া আর অন্য লোক নেই! ধূমধাড়াক্কার মহারাজা সায়েব না খেয়ে চলে যাচ্ছেন, কেউ একটা বলবার লোক নেই—
আমরা তাড়া দিলুম—বড়দা চলুন, চলুন—এখানে দাঁড়িয়ে লেকচার দিলে কি হবে! আর কথা না বলে বড়দা হস্তদন্ত হয়ে ছুটিল নীচে। আমরাও পিছু পিছু চললুম।
নীচে তখন লক্ষ্নৌয়ের সানাইওয়ালার দল বাজনা বাজিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। এবার তারা রকে বসে কিছুক্ষণ বিড়িটিাড়ি ফুঁকবে—ততক্ষণ কাশীর দল বাজাবে।
কিন্তু সানাইওয়ালা হলে কি হয়, লক্ষ্ণৌয়ে তাদের বাড়ি। মাথায় রুপোর জরিদার গোলাপী পাগড়ি, গায়ে সবুজ সিস্কের শেরওয়ানী, তার গায়ে বড় বড় সাদা ফুলতোলা, ফিকে গোলাপী সাটিনের ইজের, পায়ে বাহারী নাগরা। বড়দা সিঁড়ি দিয়ে নেমেই এই দলকে দেখতে পেয়ে দু-হাত দিয়ে তাদের পথ আগলে চীৎকার করে বলতে লাগল—সে হবে না, সে হতে পারে না। আমাদের অকল্যাণ হবে—সে হবে না।
তারা লক্ষ্ণৌয়ের লোক, বাঙলা বুঝতে পারে না। হঠাৎ একটা লোককে পথ আগলে ঐ রকম মিনতি ও অনুনয় করতে দেখে তারা প্রথমটা ভড়কেই গেল। তারা উর্দুতে বলতে লাগল—আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি, এক্ষুনি আবার ফিরে আসব।
কিন্তু কে কার কথা শোনে! বড়দা বলতে লাগল—না খেয়ে যাওয়া হবে না—এই আটটার মধ্যেই আপনাদের বসিয়ে দেব—দয়া করে যখন এসেছেন, তখন এমনি ছাড়ব না—ইত্যাদি।
এততেও লোকগুলো সদর দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে বড়দা হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকে পড়ল বাপের ঘরে।
বড়দার বাবা ছিলেন অত্যন্ত গভীর প্রকৃতির লোক। তিনি নিজের ঘরে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলেন, এমন সময় বড়দার প্রবেশ। বোধ হয় বিশ বছর বাপেতে ছেলেতে বাক্য-বিনিময় হয়নি, কিন্তু তাতে কি আসে-যায়! বড়দা চীৎকার করে বলতে আরম্ভ করে দিল—এই দেখুন বাবা, ধুমধাড়াক্কার মহারাজা সায়েব না খেয়ে চলে যাচ্ছেন। আমি এত করে বলছি, তা কিছুতেই শুনছেন না। আপনি একটু না বললে তো—
বাপ প্রথমে ছেলের ঐ আতিশয্য দেখে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—কে চলে যাচ্ছে!
—এই ধূমধাড়াক্কার মহারাজা সায়েব।
বাপ ছেলেকে চিনতেন, তাই বন্ধুদের সামনে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঢুলি, পে-ধরা ও সানাইওয়ালাকে ঐ রকম খাতির করতে দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তাদের চলে যেতে বলে তিনি বড়দাকে বললেন—নিমন্ত্রিতদের খাতির করবার লোকের অভাব বাড়িতে নেই—তুমি নিজের ঘরে গিয়ে বসে থাকো। বড়দা কয়েক সেকেণ্ড স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপরে হঠাৎ চটি-জুতো চটচটিয়ে হনহন করে নাচতে নাচতে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন—বোধ হয় বাপের নামে ঠাকুরমার কাছে নালিশ করতে।
নাদির শা ছিল শালওয়ালা। তার বাড়ি ছিল কাশ্মীর না পেশোয়ারের কোনো জায়গায়। কিন্তু তখনকার দিনে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত, কাশ্মীর প্রভৃতি দেশের যেসব লোক কলকাতায় শালের ব্যবসা করতে আসত, তাদের কাবুলিওয়ালা বলা হত। এখানকার সাধারণ লোকের ধারণা ছিল, এরা কাবুল থেকে আসে। লোকে মনে করত তারা সাংঘাতিক জীব, ভয়ে তাদের কাছে কেউ এগুত না। অথচ তাদের অধিকাংশই ছিল ভালমানুষ। নাদির শা প্রতি বৎসর শীতের সময় কলকাতায় আসত। শাল বিক্রি করতে। বাঙালীদের সঙ্গে তার কারবার ছিল। হাজার হাজার টাকার শাল লোকের বাড়িতে ধারে দিয়ে যেত। আর দু-তিন বছরে সেই টাকা আদায় হত। আমাদের পাড়ার প্রায় প্রত্যেক লোকের সঙ্গে তার দেনাপাওনার সম্বন্ধ ছিল। প্রায় প্রতি রবিবারেই সে পাড়ায় আসত, আর রকে বসে কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গে গল্পসল্প করত। তার মুখে ভাঙা-ভাঙা বাঙলা বুলি ভারি মিষ্টি লাগত।
বড়দাকে নাদির শা খুবই খাতির করত। কারণ, বড়দা শাল সম্বন্ধে যত কথা জানত, সাতপুরুষ ধরে শালের ব্যবসা করেও নাদির শা তত জানত না। সে ছিল ব্যবসাদার, তার হিসাবের খাতায় কল্পনার স্থান ছিল না, আর বড়দা বাস করত কল্পলোকে। তার উপরে ছোটবড় সব জিনিসের ওপরেই রহস্যের একটা আবরণ না দিলে বড়দা স্বস্তি পেত না। বড়দা বলত—হিমালয়ের চুড়োয়—সেই এভারেস্টের কাছাকাছি অন্ধকার গুহার মধ্যে এক রকম জীব বাস করে—তারা হয় জন্মান্ধ। তাদের গায়ের লোমে যে শাল হয়, তার তুল্য শাল জগতে আর কোথাও পাওয়া যায় না। লাসায় সে শাল পাওয়া যায়। রাজা রামমোহন রায় তিব্বত থেকে পালিয়ে আসবার সময় সেই রকম একজোড়া শাল নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর নাতিদের গায়ে সেই শাল দেখেছি।
নাদির শা ভালমানুষ হলেও বুদ্ধিমান ছিল, সে বড়দার কথার প্রতিবাদ করত না এবং এমন ভাব দেখাত যে, শাল সম্বন্ধে বড়দার কাছে সে একেবারে অজ্ঞ বললেই হয়।
একদিন রকে বসে আমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে নাদির শা বড়দাকে লক্ষ্য করে বললে—এ মহল্লার ছেলেবুড়ো সবাইকে শাল বিলি করলুম, কিন্তু আজ পঁচিশ বছরের মধ্যে বড়বাবু আমার কাছ থেকে একখানা রুমালও খরিদ করলেন না। এ আফসোস আমার জীবনে যাবে না।
আমরা বড়দার পেছনে লাগলুম—ছি, ছি বড়দা, আপনি কতদিকে কত পয়সা খরচ করেন। আর নাদির শা বেচারিকে কেন এতদিন বঞ্চিত করে রেখেছেন! আপনার মতন শৌখিন লোক শাল না কিনলে ওদের ব্যবসা চলবে কি করে?
মিনিট-পাঁচেকের মধ্যেই বড়দা গরম হয়ে উঠল। বললে—আচ্ছা নাদির শা, ভাল শাল আছে? জামেয়ার, জামেয়ার চাই।
—আছে বৈকি হুজুর, দেখুন না দয়া করে।
মুটের মাথা থেকে বিরাট বোঝা নামিয়ে নাদির শা বড়দাকে শাল দেখাতে আরম্ভ করলে। ঘণ্টাখানেক ধরে চেচামেচি করে শেষে একখানা জামেয়ার বড়দা পছন্দ করলে। চমৎকার জিনিস, দাম ছ’শো টাকা। আজকের দিনে সে জিনিসের দাম অন্তত আড়াই হাজার টাকা। শালখানা হাতে নিয়ে বড়দা খুশিতে ফেটে পড়তে লাগল। তারপর চিটি ঘষতে ঘষতে বাড়ির দিকে রওনা হল।
পরের দৃশ্য : বড়দার বাবা আপিসঘরে বসে কাজ করছেন। দু-একজন কর্মচারী আশেপাশে দাঁড়িয়ে, এমন সময় শাল বগলে নিয়ে নাচতে নাচতে বড়দার প্রবেশ। অনেকক্ষণ নীরবে অপেক্ষা করার পর বড়দার বাবাই মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলেন—কি, কি চাই তোমার?
বড়দা বগলচাপা থেকে শালখানা মুক্ত করে বাপের হাতে দিয়ে বললে—দেখুন দিকি শালখানা কেমন হবে?
শালখানা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কিছুক্ষণ দেখে তিনি বললেন—ভাল শাল।
বড়দা বললে—ছাশো টাকা দাম চাইছে।
বড়দার বাবা আবার সেখানা বেশ করে দেখে বললেন—তা বেশী বলেনি। কার শাল এটা?
—ওটা আমি নিচ্ছি, নাদির শার কাছ থেকে।
—তুমি শাল কিনছ?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—শাল নিয়ে তুমি কি করবে?
—এই কোথাও বেরুতে-টেরুতে হলে শীতকালে একখানা শাল চাই কিনা, নইলে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।
—তুমি তো বাপু জন্মে কোথাও যাও না। বুড়ো বয়সে আমাকে ছুটতে হয় লোকের বাড়ি নেমস্তন্ন রক্ষে করতে।
—এবার থেকে ভাবছি আমিই যাব।
—বেশ ভাল কথা। আমার দশ-বারোখানা ভাল শাল আছে, তাই গায়ে দিয়ে যেও। মিছিমিছি ছশো টাকা দিয়ে শাল কেনবার এমন কিছু দরকার নেই। বড়দা শালখানা নিয়ে আসছিল, কিন্তু বহুদর্শী পিতা বললেন—ওখানা আমার কাছে রেখে যাও, নাদির শা এলে আমিই তাকে ফিরিয়ে দেব।
পরের দিন সকাল বেলা আড্ডার দিকে যাচ্ছি, দেখি বড়দা নিজেদের বাড়ির সামনে মুখটি চুন করে দাঁড়িয়ে আছে। বললুম—চলুন বড়দা, রকে যাবেন না? বড়দা ইংরেজিতে বললে—No ।
হঠাৎ বড়দার এই ভাবান্তর ও ভাষান্তর দেখে কৌতুক বোধ করলুম। জিজ্ঞাসা করলুম—কি হয়েছে বড়দা? বড় ম্লান দেখাচ্ছে আপনাকে।
বড়দা ইংরেজিতে বললে—I am in great distress. Can you lend me twenty rupees? Payable when able.
—আমার কাছে তো টাকা নেই বড়দা।
—টাকা নেই তো ধার করে এনে দাও।
—আমাকে কে টাকা ধার দেবে বড়দা?
—আমাদের দরোয়ানের কাছ থেকে ধার নাও, আমি বলে দিচ্ছি।
বড়দার পেছনে লাগলেও আমাদের সঙ্গে তার প্রাণের যোগ ছিল। তার বিপদে সাহায্য করা এমন একটা ভয়ানক কার্য কিছু ছিল না। বললুম—বেশ, দরোয়ানকে বলে দিন আমাকে দিতে।
কিন্তু সৌভাগ্য অথবা দুভাগ্যক্রমেই হোক দরোয়ানকে তখন খুঁজে পাওয়া গেল না।
সেইদিনই বিকেলে পাড়াময় হৈ হৈ লেগে গেল বড়দা বাড়ি থেকে পালিয়েছে। বেলা একটার সময় স্নান করে আর বাড়ির মধ্যে খেতে যায়নি। নিজের ঘরে গিয়ে আলখাল্লা পরে বেরিয়ে গিয়েছে। ছেলেরা কেউ বাড়ি নেই, যে যার কাজে গেছে। শুধু এক ভাই বাড়িতে ছিল, সে ছুটোছুটি করতে লাগল। বাপ শুনে গুম হয়ে বসে রইলেন। বাড়ির মধ্যে ঠাকুরমা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিলেন।
তদন্তে প্রকাশ হল, আমার সঙ্গে দেখা হবার পর পাড়ার আর একটি ছেলের সঙ্গে বড়দার দেখা হয়েছিল। ওই ছেলেটির নাম নগেন। বড়দার নামও ছিল নগেন, তাই সে একে ‘মিতে’ বলে ডাকত। নগেনের কাছে টাকা চাইতে সে বড়দাদের দরোয়ানের কাছ থেকে কুড়ি টাকা ধার করে তাকে দিয়েছে, অবশ্য payable when able system-এ। শুধু তাই নয়, বড়দা নগেনকে বলেছে যে, একজন গরিব বিধবাকে কাশী যাবার জন্য কুড়িটি টাকা দেবার প্রতিজ্ঞা সে করেছিল—তাকে সে টাকা দিতে না পারলে তার মাথাকাটা যাবে। নগেনকে দিয়ে বড়দা city Booking office থেকে একখানা কাশী যাবার তৃতীয় শ্রেণীর টিকিটও আনিয়েছে। টিকিট কিনে এনে দিয়েছে বেলা চারটের সময়।
টাইম টেবিলে দেখা গেল কাশী যাবার একখানা প্যাসেঞ্জার গাড়ি ছাড়ে সন্ধ্যে ছটায়। আদ্যোপান্ত ব্যাপার শুনে আমরা সিদ্ধান্ত করলুম বড়দা নিশ্চয় কাশী পালিয়েছে। কিন্তু তার ভাইরা সে কথা বিশ্বাস করলে না। কোন বিধবাকে টাকা দেওয়া সম্ভব তারই জল্পনা করতে লাগল। আমরা আর কালবিলম্ব না ক'রে দশ-বারোজনে ছুটিলুম হাওড়া স্টেশনে।
স্টেশনে পৌঁছে ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে লোক দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা তিন-চারজনে প্ল্যাটফরমে ঢুকলুম। গাড়ি ছাড়তে তখন বোধ হয় মিনিট দশেক দেরি—ভিড়ে অগ্রসর হওয়া যায় না। আমরা দুজন ‘বড়দা’ ‘বড়দা’ বলে চীৎকার করে স্টেশনের এমুড়ো থেকে ওমুড়ো দৌঁড়তে লাগলুম আর দুজনে গাড়িতে গাড়িতে উঁকি মেরে দেখতে লাগল—কিন্তু বড়দার সন্ধান পাওয়া গেল না। শেষকালে আমরা ‘বড়দা’ ছেড়ে ‘নগেনবাবু’ নগেন’, ‘ওরে নগা' বলে চ্যাঁচাতে লাগলুম, কিন্তু কোথায় সে!
একজন বুদ্ধি দিলে, দেখ, এমনিতে হবে না, এস গালাগালি দিয়ে ডাকতে আরম্ভ করা যাক। যাহাতক বলা ওমনি চতুর্মুখ দিয়ে হুঙ্কার বেরুতে লাগল—‘ওরে শালা নগা’, ‘নগা শালা আর কত জ্বালাবি রে!’ ‘নগেন শালা বেরিয়ে পড় না' ইত্যাদি।
গালাগালির কি অপূর্ব মহিমা! আমরা যতক্ষণ ‘বড়দা’, ‘নগেনবাবু’ ইত্যাদি বলে চীৎকার করছিলুম ততক্ষণ স্টেশনের কোনই লোকই ভ্রুক্ষেপ করছিল না। নামের আগে পেছনে ‘শালা’ শব্দটি জুড়তেই স্টেশন সুদ্ধ লোক সচকিত হয়ে উঠল। যারা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তারা জিজ্ঞাসা করতে লাগল—কি হয়েছে মশায়? কাকে খুঁজছেন আপনারা?
যারা স্টেশনের ধারের বেঞ্চে বসেছিল তারা কোমর অবধি বের করে ঝুকে দেখতে লাগল। গাড়িতে গাড়িতে যত ‘নগা’ ও ‘নগেন’ ছিল তারা ঠিকরে বেরিয়ে পড়তে লাগল। এমনকি ইঞ্জিনটা পর্যন্ত গাঁক গাঁক করে ডাক ছাড়তে আরম্ভ করে দিলে।
ইঞ্জিন থেকে গার্ডের গাড়ি অবধি বারছয়েক ‘নগা শালা' বলে চেচিয়ে ছুটোছুটি করতেই দেখা গোল আমাদের বড়দা একটা প্রথম শ্রেণীর কামরা থেকে বেরিয়ে আসছেন। আমরা তো তাকে দেখেই ধরে ফেললুম। তখুনি আমাদের চারপাশে কৌতুহলী দর্শকের ভিড় লেগে গেল।
ভিড় থেকে বেরিয়ে একটু ফাঁকে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র—আমরা কিছু বলবার আগেই বড়দা শুরু করে দিলে—বাপের বয়সী ভাইকে শালা সম্বন্ধী করে খুব বাহাদুরি হচ্ছে না? এত লোকের সামনে এমন করে আমাকে অপমান না করলে আর চলছিল না, কেমন?
তারপরে যে ভাষায় সে কথা বলতে আরম্ভ করলে তা আর ছাপানো যায় না।
টের পাওয়া গেল বড়দা একটা থার্ড ক্লাস কামরার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। দূর থেকে আমাদের দেখতে পেয়ে একটা প্রথম শ্রেণীর পায়খানায় ঢুকে লুকিয়ে ছিল, কিন্তু গালাগালি বরদাস্ত করতে না পেরে শেষকালে বেরিয়ে পড়েছে।
আমরা বললুম—যা হবার তা হয়ে গিয়েছে, গালাগালি যা দিয়েছি, তার জন্য পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছি—এবার আপনি বাড়ি চলুন।
বড়দা বললে—বাড়ি আর আমি ফিরব না। কাশী চললুম, আমাকে বাবায় টেনেছে। কার সাদ্ধি আমাকে ফেরায়, বাবার টান—
ভোঁ করে বাঁশি দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। বড়দা আমাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলতি ট্রেনের দিকে ছুটল। স্টেশন সুন্ধু লোক হৈ হৈ করে উঠল। দুজন টিকিট-চেকার তাকে ধরে ফেলতেই সে ভয়ে তাদের হাত ছাড়িয়ে আমাদের আশ্রয়ে এসে দাঁড়াল।
বড়দাকে নিয়ে তো আমরা প্লাটফরম থেকে বেরিয়ে পড়লুম। আমাদের দলের অন্য যারা বাইরের ঘাঁটি আগলাচ্ছিল, তারা সব এসে জুটল। বড়দাকে আমরা অনুনয় করতে লাগলুম—বড়দা, লক্ষ্মীটি বাড়ি চলুন।
বড়দা গ্যাঁট হয়ে বসে রইল। বলতে লাগল—যে বাড়িতে এত বড় ছেলের ইজ্জত নেই, সে বাড়ি আমার নয়, আমি কাশী চলে যাব।
বেগতিক দেখে বড়দার ঠাকুরমাকে নিয়ে আসবার জন্য জন-তিনেক বাড়ির দিকে ছুটল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বড়দার ঠাকুরমা ও ছোট ছেলে গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হল।
ঠাকুরমা বললেন—চল নগা, বাড়ি চল।
বড়দা কিছুতেই উঠবে না। সে বলতে লাগল—আমি আর বাড়ি যাব না, আমায় বাবা টেনেছে—যে বাড়িতে এত বড় ছেলের ইজ্জত থাকে না, সেখানে ফিরে গিয়ে কি হবে?
ঠাকুরমা কাঁদতে লাগলেন। দেখাদেখি বড়দাও কাঁদতে আরম্ভ করে দিলে। ঠাকুরমা বলতে লাগলেন—চল, বাড়ি চল, লক্ষ্মীধন আমার, জাদু আমার,-আমি তোকে দশখানা শাল কিনে দেব! বড়দা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল—আমার জামা নেই, জুতো নেই, কিছু চাইনে আমি—একখানা শালের জন্য এত অপমান!
বড়দা কিছুতে উঠবে না, ঠাকুরমাও কিছুতে ছাড়বে না। পচাঁশি বছরের ঠাকুরমা—তাঁর নাতির নাতিদের হাতে-খড়ি হয়ে গেছে—বাহান্ন বছরের নাতির সঙ্গে সে কি মান-অভিমানের পালা!
শেষকালে ঠাকুরমা বললেন—চল নগা, আজ কিমার পুর দিয়ে তোকে পুরি তৈরি করে দেব।
কিমার পুর দিয়ে পুরির কথা শুনে বড়দা বিচলিত হয়ে উঠল। একটু চুপ করে থেকে সে বললে—তোর সব মিছে কথা! সেদিন কিমার পুরি তৈরি করবি বললি আর খেতে গিয়ে দেখি ঠাকুর শালা ডালপুরি বেঁধে রেখেছে।
ঠাকুরমা বললে—ছি বাবা, বামুনকে কি গালাগালি দিতে আছে? চল আজ তোকে আমি নিজের হাতে কিমার পুরি তৈরি করে দেব।
এবার বড়দা উঠে পড়ল। আমাদের চারপাশে তখন দু-পাঁচ হাজার লোক দাঁড়িয়ে গেছে। ভিড় ঠেলে স্টেশনের বাইরে এসে বড়দাদের গাড়িতে তুলে দিয়ে আমরা বাড়ি ফিরলুম।
খাওয়া-দাওয়ার কথা উঠলে বড়দার জ্ঞান থাকত না। নিত্য নতুন খাবার নিজের মাথা থেকে উদ্ভাবন করে ঠাকুরমাকে গিয়ে সে ফরমাশ করত, আর সামান্য একটু ইতরবিশেষ হলে পাচকঠাকুরের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে ছাড়ত।
শুধু তাই নয়, অন্যান্য জিনিসের মতন খাদ্য সম্বন্ধীয় ব্যাপারটার ওপরেও সে একটা রহস্যের আবরণ দেবার চেষ্টা করত।
বড়দা বলত—পঁচিশ বছর আগে লক্ষ্নৌয়ের এক বাবুচি নবাব বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে মারহাট্টা ডিচের কাছে এক খোলার বাড়িতে লুকিয়ে ছিল। আমার কাছে বাবা ঠিক খবর আসে। খুঁজে খুঁজে একদিন সন্ধ্যের সময় ঠিক তাকে ধরে ফেলা গেল। ইয়া ঘাড় অবধি ধপধাপে সাদা বাবরি চুল—বুক অবধি লম্বা সাদা দাড়ি। আরো প্ৰথমে সে কি মানতে চায়। সেদিন তো একরকম তাড়িয়েই দিলে। আমিও নাছোড়বান্দা; পরের দিন আবার গেলুম। সেদিনও সে রাজী হল না। তার পরের দিন আমার কথাবার্তায় খুশী হয়ে একদিন রান্না করে খাওয়াতে রাজী হয়ে বললে—আচ্ছা বাবু, বল তুমি কি খাবে?
বললুম—মাংস-টাংস কিছু রেঁধে খাওয়াও, আমরা বাঙালী, মাছ তো দু-বেলা খাচ্ছি—
আমার কথা শুনে বুড়ো বললে—আচ্ছা বাবু আমি তোমায় মাছই রেঁধে খাওয়াব৷ কাল সন্ধ্যের পর এস।
বাবুর্চি মিঞাকে সেদিন দশটি টাকা দিয়ে বললুম—এই নিয়ে তুমি জিনিসপত্র কেন। তোমায় বখসিস কাল দোব।
পরের দিন সন্ধ্যের পর বাবুচির বাড়ি যাওয়ামাত্র আমাকে খুব খাতির করে বসালে। বললে—বাবু ঠিক সময়ে এসেছ, আর একটু দেরি হলে মাছ ঠাণ্ডা হয়ে যেত।
এই বলে একটা ফরাশের ওপর আমাকে বসিয়ে তক্ষুনি বাড়ির ভেতরে গিয়ে একটা প্লেট এনে আমার সামনে রাখলে। প্লেটের ওপরে দেখি এক হাত লম্বা আর এক বিঘত চওড়া একটা কৈ মাছ। এত বড় কৈ মাছ জন্মে কখনো দেখিনি। মাছটাকে এমন করে রাঁধা যে তার চোখ দুটো তখনো একেবারে জ্যান্ত মাছের মতন জ্বলজ্বল করছিল। মনে হতে লাগল আমার দিকে চেয়ে চেয়ে যেন সেটা বলছে—কি রে আমায় খাবি নাকি?
মিনিট-দুয়েক তো আমি হাঁ করে প্লেটের দিকে চেয়েই রইলুম।
বাবুর্চি বললে—বাবুসায়েব, খেতে শুরু করুন—খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
তারপরে ভাই মাছটায় যেমন হাত দিয়েছি অমনি সেটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। আমি তো ভয়ই পেয়ে গেলুম। এ কি মাছ! না মাছের ভূত? কি জানি বাবা, লক্ষ্নৌয়ের ব্যাপার, কিছু বলা যায় না।
তবুও অপ্রস্তুত হবার ভয়ে আমি সেটাকে প্লেটের সঙ্গে চেপে ধরলাম। কিন্তু সে কি জোর! আমার হাত ছাড়িয়ে সেটা প্লেটময় লাফিয়ে বেড়াতে আরম্ভ করে দিলে। দুহাতে সেটাকে চেপে ধরে রাখতে পারি না—এমন কাণ্ড।
শেষকালে বাবুর্চি একটা কাঁটা ও ছুরি এনে দিতে সেটাকে কাঁটায় চেপে ধরে একেবারে আট-দশটা টুকরো করে ফেললুম। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবি নে—সেই কাটা টুকরোগুলো পর্যন্ত প্লেটময় তুরতুর করে লাফিয়ে বেড়াতে লাগল।
বাবুচিকে জিজ্ঞাসা করলুম—ব্যাপার কি বল দিকিন?
বাবুচি বললে—ও মসল্লার গুণ!
তারপরে এক টুকরো মাছ মুখে দিয়ে বুঝলুম—আহা!
এই বলে বড়দা শিবনেত্র হয়ে টাকরায় জিব দিয়ে জোরে টাই করে এমন একটা শব্দ করলে যে মাথার ওপরে কার্নিশে কতকগুলো পায়রা বসেছিল—ছররা ছাড়া হচ্ছে মনে করে তারা ফরফর করে উড়ে পালিয়ে গেল।
এই রকম দিল্লি, আগ্রা, বেরিলী, উইলসনের হোটেল, গ্র্যাণ্ডহোটেল থেকে পালিয়ে আসা বাবুর্চিদের অদ্ভুত রান্নার কথা বলতে বলতে বড়দা দস্তুরমত উত্তেজিত হয়ে উঠত। কিন্তু কেন যে তারা তাদের নির্দিষ্ট চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতার অতি জঘন্য সব গলিতে এসে আত্মগোপন করে বাস করে এবং অতিরিক্ত পয়সার বিনিময়েও লোককে খাবার তৈরি করে দিতে রাজি হয় না এবং কেনই বা তারা বড়দার অনুরোধ ঠেলতে পারে না—সে রহস্যের আবরণ কোন দিনই আমরা উন্মোচন করতে পারিনি।
একদিন আমরা জিজ্ঞাসা করলুম—বড়দা, কামধেনুর দুধ খেয়েছেন?
—কামধেনু কি?
—যার দুধ খেলে চিরযৌবনই থেকে যায়, লোকে আর কখনো বুড়ো হয় না। বড়দা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বার দু’তিন ঢোঁক গিলে বললে—না, কামধেনুর দুধ খাইনি। তবে সোনার হাঁসের ডিম খেয়েছি। তাতে ঐ ফল একই হয়, মানুষ যে বয়সে খায় সেই বয়সেই থেকে যায়।
—বলেন কি বড়দা? সোনার হাঁসের ডিম একমাত্র বইতেই পাওয়া যায়, বাজারে তো বিক্রি হয়না।
—যায় রে যায়। তেমন করে খুঁজলে বলে ভগবানকে পাওয়া যায় তো সোনার হাঁসের ডিম।
—আচ্ছা, অতখানি একতাল সোনা গিললেন কি করে? গলায় বাধল না?
—দূর বোকা! ডিমটা কি সোনার তৈরী? খোলটা দেখলে মনে হয় যেন সোনার। মনে হয় যেন হ্যামিলটনের বাড়িতে অর্ডার দিয়ে তৈরী করানো হয়েছে। ভাঙবার সময় আওয়াজও হয় টুং-টাং করে। ভেতরের পদার্থটি যেন সোনা গলানো। কাঁচা খেতে হয়, খেতে একেবারে মধুর মত মিষ্টি।
বড়দা বলে যেতে লাগল—সমুদ্রের মধ্যে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় যে চুড়া একেবারে সমুদ্রের ওপর ঝুলে পড়েছে এমন জায়গায় এই সব হাঁস বাসা বাঁধে। এই হাঁস ধরতে গিয়ে কত দেশের কত লোক যে প্ৰাণ দিয়েছে তার ঠিকানা নেই—জোড়া ধরতে হবে কিনা! একমাত্র ঈগল পাখিরাই নির্বিবাদে ওদের ডিম খেতে পায়। ক্রমেই এই হাঁস পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
আমরা বললুম—আপনি তো আর ঈগলপাখি নন, আপনার বরাতে সে ডিম জুটল কি করে?
বড়দা বললে—অনেক দিন আগে থাকতেই শুনছিলুম। বার্মার একজন মুসলমান এই রকম এক জোড়া হাঁস জোগাড় করেছে। কয়েক বছর পরে সন্ধান পেলুম লোকটা কলকাতায় এসেছে। সেই দিন থেকে তকে তক্কে ফিরতে লাগলুম। শেষকালে একদিন রাতদুপুরে ছকু খানসামা লেনের এক খোলার বাড়িতে তাকে গিয়ে ধরলাম। লোকটা প্রথমে তো মানতেই চায় না। আরে বাবা, আমার কাছে উড়বি কতক্ষণ।—শেষকালে ধরা পড়ে গেল।
দস্তুরমত ঠিক হয়ে গেল—একটা ডিমের দাম একশো টাকা। সে হাঁস আবার আমাদের দিশী হাঁসের মতন অগুন্তি ডিম দেয় না, মাসে একটা ডিম পাড়ে। আমার বারোটি ডিমের দরকার। কারণ উপরি উপরি বারো মাসে বারোটি ডিম খেতে পারলে যে বয়সে খাবে সেই বয়সেই থেকে যাবে। যা হোক, প্রতি মাসে নির্দিষ্ট তারিখে রাত্ৰি বারোটার সময় গিয়ে একটি করে ডিম খেয়ে আসতে লাগলুম। কিন্তু আমার যেমন কপাল, দশ মাস খাওয়ার পর এগারো মাসে গিয়ে দেখি লোকটা সরে পড়েছে—আমার হাজারটা টাকা লোকসান গেল।
মৌলভী লিয়াকৎ হোসেন ছিলেন স্বদেশী যুগের একজন নেতা। ভদ্রলোক সারাজীবন ধরে হিন্দু-মুসলমান মিলনরূপ সোনার পাথরবাটির স্বপ্নেই কাটিয়ে গেছেন। একবার সরকারী আদেশ অমান্য করে তাঁর বছর আড়াই-তিনের কারাদণ্ড হয়। জেল থেকে বেরিয়ে এসে জীবিকা উপার্জনের জন্য আমাদের পাড়ায় একটা মনোহারী দোকান খুলেছিলেন। দোকানে সামান্য দু-তিন শিশি গুড়ের লজঞ্চুস, পেন-হোল্ডার, ExerciseBook. মোষের শিংয়ের বোতাম, চিরুনী, কাগজ—এই ছিল বিক্রয়ের সামগ্ৰী। কিন্তু জিনিস সামান্য হলে কি হয়, তিনি দোকানের নাম দিয়েছিলেন ‘কুবের ভাণ্ডার’। মৌলভী সায়েব এই দোকানঘরেই বাস করতেন। তাঁর কাপড়-চোপড়ও ঘরের এক কোণে ঝোলানো থাকত। রাত্রে ছোট একটি টিমটিমে আলোতে ঘরখানার দারিদ্র্য যেন আরও ফুটে উঠত। আমরা দু-তিনজন একদিন গোপনে বড়দাকে বললুম—বড়দা, Spences Hotel থেকে একজন উঁচুদরের বাবুর্চি পালিয়ে এসেছে।
বড়দা একেবারে লাফিয়ে উঠলা—কোথায় কোথায়?
বললুম—পাছে লোকে জ্বালাতন করে এই ভয়ে সে অমুক জায়গায় ‘কুবের ভাণ্ডার’ নাম দিয়ে একটা দোকান খুলেছে। কিন্তু ও-সব দোকান-টোকান কিছুই নয়—সব আত্মগোপন করার ছল মাত্র। শুনেছি তার রান্না খেলে নাকি মরা মানুষ বেঁচে ওঠে।
কথাটা বড়দার মনে খুব লাগল। বললে— বলিস কি রে। দোকানটা দেখিয়ে দিস তো।
সেদিনই বিকেল বেলায় দূর থেকে বড়দাকে দোকানটা দেখিয়ে দেওয়া গেল।
পরের দৃশ্য : রাত্রি প্রায় আটটা। কুবের ভাণ্ডারের মধ্যে মৌলভী সায়েব বসে আছেন বিষন্ন মুখে। সেই সকালে পয়সা দু-একের লজঞ্চুস বিক্রি হয়েছে— মন-মেজাজ তাঁর অত্যন্ত খারাপ, বোধহয় সকালবেলার আহারাদিও হয়নি। টিমটিম করে আলো জ্বলছে— এমন সময় দরজার কাছে বড়দার আবির্ভাব। তিনি ভয়ে ঘরের মধ্যে না ঢুকে সেইখানে দাঁড়িয়েই লক্ষেী উর্দুতে মৌলভী সায়েবকে ডাক দিলেন— এই, একবার শুন তো ইধার আকে।
মৌলভী সায়েব লোকটার পোশাক, হালচাল ও ভাষা শুনে একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— কেয়া হ্যায়! কওন হ্যয় তুম? কেয়া মাংতা?
বড়দা বললে— আরে বাবা, একটু ইধার আকে শুন না! চেঁচিয়ে বোলেগা তো তুমহারাই খারাপ হোগা।
মৌলভী সায়েবের স্বভাবটা ছিল কিছু উগ্ৰ। যারা তাঁকে চিনত না তারা মনে করত লোকটা সব সময়ে চটেই আছে। সেদিন তাঁর মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল। তবুও বড়দার আহ্বানে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বড়দা চারিদিক একবার ভাল করে দেখে নিয়ে খুব আস্তে আস্তে বললে— চপ হয়, চপ?
মৌলভীর মেজাজ তখন চড়তে আরম্ভ করেছে। তিনি চীৎকার করে উঠলেন— কেয়া বোলতা? ইয়ে শালা পাগলা হ্যয় না কেয়া!
—আরে বাবা চীৎকার কাহে করতা? জরা ধৈর্য ধরকে শুনো না। তুম তো স্পেনসেস হোটেলসে ভাগকে আয়া? চপ তৈরি হ্যয়? হাম সব জানতা হ্যয়, হামকো বেচুনে সে কুছ গোলমাল নেহি হোগা।
এর পরের ব্যাপারটা সহজেই অনুমেয়। মৌলভী সায়েব যাচ্ছেতাই ভাষায় গলাগলি দিতে আরম্ভ করলে। বড়দা তাতেও না যাওয়ায় শেষকালে কোণ থেকে বাঁশের ডাণ্ডা বের করায় বেগতিক দেখে বড়দা পলায়ন করলে।
পরের দিন বড়দাকে জিজ্ঞাসা করায় সে বললে— এখনো খোঁজ নিইনি— দু-একদিনের মধ্যেই যাব— দেখব তোমাদের স্পেনসেস হোটেলের বাবুর্চি কেমন রাঁধে।
বড়দার বাবার বয়স সত্তর পেরিয়ে গিয়েছিল। তিনি সারা জীবন শূলবেদনায় ভুগছিলেন, ইদানীং বড় একটা বাইরে বেরুতেন না। দুই ছেলে আর দুই নাতি অথাৎ বড়দার দুই ছেলে— এরাই ব্যবসা দেখছিল। এইসময় দিনকয়েক অসুখের বাড়াবাড়ি হয়ে তিনি মারা গেলেন— বড়দার ঠাকুরমা তখনো জীবিত।
বাপের শ্ৰাদ্ধশান্তি মিটে যাবার পর বড়দাদের বিষয় ভাগাভাগি হয়ে গেল। ভাইয়েরা খুব ভাল, তারা চুল চিরে তিন ভাগ করে এক ভাগ বড়দাকে দিলে। পৈতৃক ব্যবসা এক রইল বটে। কিন্তু তার লাভালাভ তিন ভাগ করে একভাগ বড়দার দুই ছেলেকে দেওয়া হল। উপরন্তু বড়দার নামে সেই যে পঁচিশ হাজার টাকার বীমা করা হয়েছিল, সেই টাকার তাড়া বড়দাকে দিয়ে দিলে। বিষয় ভাগের সময় ভাইরা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল— বড়দা, তোমার কি চাই? কোন বাড়িটা কিংবা কোনো জিনিসের উপর যদি তোমার ঝোঁক থাকে তো বল, সেটা তুমি পাবে।
বড়দা বললে— ঠাকুরমাকে আমার ভাগে চাই।
পাড়ার লোকেরা মনে করেছিল বড়দার ভাইয়েরা তাকে বিষয় থেকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করবে, জাল উইল বের হবে, তারপরে হাইকোর্ট ছুটোছুটি হবে। অন্তত তাদের বড় বাড়ির মধ্যে দুটো দেওয়াল উঠে বাড়িখানা তিন ভাগে বিভক্ত হবে। কিন্তু সেদিক দিয়ে কোথাও কিছুই পরিবর্তন হল না, পরিবর্তন এল শুধু বড়দার জীবনে— যা তারা স্বপ্নেও কোনদিন মনে করতে পারেনি।
পিতৃ-শ্রাদ্ধের পর ন্যাড়া মাথায় তখনো আধা ইঞ্চি চুলও বাড়েনি এমন সময় বড়দা গিয়ে সাহেব-বাড়ি থেকে চুল ছাঁটিয়ে এল। বাপের মৃত্যুর দিনে সেই যে সে কৌপীন খুলে ফেললে আর তা পরলে না। আগেই বলেছি বড়দার বাবা খুব শৌখিন লোক ছিলেন। মারা যাবার কিছুদিন আগে তিনি খুব দামী একটা মি-লর্ড ফিটন গাড়ি ও ঘোড়া কিনেছিলেন, এই গাড়ি ও ঘোড়া বড়দার ভাগে পড়েছিল। বড়দা বাহান্ন ইঞ্চি শান্তিপুরী কোঁচান ধুতি, গিলে-করা ঢাকাই মোসলিনের পাঞ্জাবি, বুটিদার ঢাকাই চাদর গায়ে দিয়ে, দামী দামী আতর মেখে প্রতিদিন বিকেলে বেড়াতে যেতে লাগল।
সকালবেলা রকে আর বড়দা আসে না। বিকেলে আমরা রকে বসে আড্ডা দিই— বড়দার গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে গম গম করে চলে যায়, সে ফিরেও দেখে না— আতরের গন্ধে রাস্তা মাতোয়ারা হয়ে যায়।
বড়দার এই নতুন হালচাল দেখে আমাদের বড় অভিমান হল। অবিশ্যি একথা সত্য যে, তার সঙ্গে আমাদের কোন জায়গাতেই মিল ছিল না। সে ছিল আমাদের বাপের বয়সী, সে ছিল ধনীর সন্তান, তায় আধ-পাগলা। আমরা তার পেছনে লাগতুম, রেগে গিয়ে সে মুখখিস্তি করে আমাদের গালাগালি করত। এসব সত্ত্বেও তার প্রাণখোলা মিষ্টি ব্যবহার, নিরাভিমানিতা ও নিরস্তর সাহচর্যের ফলে আমাদের মধ্যে অলক্ষ্যে একটা অন্তরের যোগ স্থাপিত হয়েছিল। বিশেষত আমি ও আরো তিনজন বড়দাকে ভালই বেসেছিলুম। সে যখন আমাদের এইভাবে উপেক্ষা করে নিত্য বুকের ওপর দিয়ে মি-লর্ড ফিটনে চড়ে যাতায়াত করতে লাগল, তখন আড্ডার অন্য ছেলেরা আমাদের ঠাট্টা করতে আরম্ভ করে দিলে।
এইভাবে মাস তিনেক কাটবার পর একদিন রবিবার দুপুরবেলা আমরা চারজনে বড়দার বাড়িতে গিয়ে তাকে ধরলাম। বললুম— বড়দা, বাপের বিষয় পেয়ে ভাইদের একেবারে ভুলে গেলেন? মায়ের পেটের ভাই হলে তো ভুলতে পারতেন না, পাড়া-সম্পর্কে কি না—
বড়দা একটুও অপ্ৰস্তৃত না হয়ে বললে— কি রকম, কি রকম? নিজেরা আমায় ত্যাগ করে আবার উল্টো চাপ দেওয়া হচ্ছে? বেড়ে মজা তো! মিনিট-পাঁচেকের মধ্যে বড়দার সঙ্গে মিল হয়ে গেল। বড়দা বললে— বিকেলে কি করবি? চল না দিব্বি বেড়াতে যাওয়া যাবে।
বিকেলবেলা স্নান করে ধোপ-দোস্ত জামা-কাপড় পরে চার মূর্তিতে বড়দার বাড়িতে গিয়ে হাজির হওয়া গেল। বড়দা তখন কাপড়াচোপড় পরে তৈরী। সে আমাদের গা শুকে বললে— অ্যাঃ, গা দিয়ে যে ধোপার বাড়ির গন্ধ বেরোচ্ছে রে— নে নে, আতর মেখে নে—
এই বলে সে একহাত লম্বা ও সেই অনুপাতে চওড়া একটা রুপোর বাক্স বের করে ডালটা খুলে ফেললে। তার ভেতর ভেলভেটের খোপের মধ্যে কত রকমের বাহারী ছোট বড় আতরের শিশি। আমরা সর্বাঙ্গে তেল মালিশ করার মত আতর মেখে নীচে নেবে গেলুম। গাড়িতে উঠে পকেট থেকে সোনার সিগারেট কেস বের করে কল টিপে পট করে ডালাটা খুলে ফেলে বড়দা বললে— নে, একটা একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেল।
সিগারেট তো দূরের কথা—এর আগে বড়দাকে কোনদিন নস্যি পর্যন্ত নিতে দেখিনি। তারপরে আমরা পাঁচজন ঠেসাঠেসি করে গাড়িতে বসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে রকের বন্ধুদের বিস্মিত দৃষ্টির বুকের ওপর দিয়ে পাড়া কাঁপিয়ে বেরিয়ে গেলুম। সন্ধ্যে অবধি গড়ের মাঠ ও গঙ্গার ধারের রাস্তায় ঘোরবার পর আমাদের গাড়ি চলল চিৎপুর রোডের ওপর দিয়ে —তারপরে খোদ জায়গায় একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।
বড়দার হাল-চাল দেখে আমাদের বিস্ময়ের মাত্রা এত বেড়ে চলেছিল যে, মুখ দিয়ে কোনো প্রশ্ন পর্যন্ত বেরুচ্ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল— ততঃ কিম?
এদিকে গাড়ি থামা মাত্র বড়দা বালকের মত টপ করে লাফিয়ে নেমে আমাদের বললে— নেমে আয়। বড়দার পিছু পিছু অন্ধকার উঠান ও সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলার একটা বড় ঘরে ঢোকা গেল। ঘরের মধ্যে দুটো মাঝারি গোছের, ইলেকট্রিক ঝাড় জ্বলছে, মেঝেতে দামী কার্পেট ও তাকিয়া। একদিকে একটা ভাল হারমোনিয়াম ও তবলা-বাঁয়া— আসার সাজান, খালি বসলেই হয়।
আমরা তো যে যার এক-একটা তাকিয়া নিয়ে বসে গেলুম। বড়দা চেঁচাতে লাগল— কৈ, কারুকে দেখতে পাচ্ছি না কেন! কোথায় গেল সব। অনুমতি— ও অনুমতি, ভীখন—
‘অনুমতি’ নাম শুনেই তো আমরা হেসে উঠলুম। বড়দা বললে— হাসিসনি। নাম শুনেই হাসি, চেহারা দেখলে তো তাহলে কাঁদতে থাকিবি।
বলতে না বলতে ঘরের মধ্যে এক বৃদ্ধার প্রবেশ। স্ত্রীলোকটির মাথার চুল পাকেনি বটে, কিন্তু অতীত জীবনে সংগৃহীত পণ্যসম্ভারে দেহ তার একেবারে নুয়ে পড়েছে। বড়দা বললে— কি রে, কোথায় থাকিস তোরা। বন্ধুবান্ধব নিয়ে এলুম, তাদের খাতির করবার একটা লোক নেই।
স্ত্রীলোকটি আসরের দিকে চেয়ে আমাদের দেখে বললে— এরা সব বুঝি তোমার বন্ধু?
বড়দা বললে, বন্ধু, প্ৰাণের বন্ধু।
এই বলে আসর ছেড়ে উঠে সে স্ত্রীলোকটিকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেল। বড়দা ঠিকই বলেছিল— এইবার বোধহয় কাঁদবার পালা শুরু হল। হায়, হায়, এই স্ত্রীলোকের সঙ্গে বসবার জন্য কি এত করে আতর মেখেছিলুম।
গুজগুজ করে আমরা নিজের নিজের মন্তব্য প্রকাশ করছি এমন সময় হাসিমুখে বড়দা ঘরে ঢুকাল। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম— এই কি বড়দার অনুমতি নাকি?
—দূর, ও অনুমতির মা, ওর নাম গণেশ! বড়দা বলতে লাগল— ছেলেবেলা আমি ঐ গণেশের কাছে আসা-যাওয়া করতুম। ওর যা চেহারা ছিল— আজ ওকে দেখে তোরা কল্পনাই করতে পারবি নে। একটা বছর দু-তিনের মেয়ে ছিল ওর। তার নাম ছিল শান্তি। দু-চারবার যাওয়া-আসা করতেই গণেশের সঙ্গে আমার বড্ড ভাব হয়ে গেল। একদিন গণেশ বললে— নগা, আমায় রাখ না ভাই। এর-তার কাছে দেহ বেচে বেড়াই, কোথায় কোন দিন ভেসে যাব— অথচ তোকে আমি ভালবাসি। আমাকে তোর কিছু দিতে হবে না, শুধু আমার ও মেয়েটার যা খরচ — ভাত-কাপড়ের।
শুনে বড় দুঃখু হল। বললুম— গণেশ, তুই কিছু ভাবিসনি। কথা দিচ্ছি, আমি তোকে রাখব। তখন আমি চাকরি শুরু করেছি, ষাট টাকা মাইনে পাই। ভাবলুম মা আর ঠাকুরমার কাছ থেকে কিছু কিছু নিয়ে গণেশের খরচ একরকম চালিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু মারে কেষ্ট রাখে কে! কয়েকটা মাস যেতে না যেতেই বাবা আমার নামে এমন বীমা করিয়ে দিলেন যাতে মাইনের সব টাকাটাই চলে গেল। আমি রেগেমেগে চাকরি ছেড়ে দিলুম। সেই থেকে আর গণেশের কোনো খোঁজই করিনি। বাবা মারা যাবার পর সাবালক হয়েই গণেশকে খুঁজে বার করলুম। গণেশ কাঁদতে কাঁদতে বললে— নগা, কি দেখচিস। দেখ, আমার কি হাল হয়েছে।
গণেশ আমার সব কথাই জানত। আমি না এলেও ভেতরে ভেতরে সে আমার সন্ধান নিত। ওকে বললুম— যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে, এবার আমি সাবালক হয়েছি, হাতে টাকাও এসেছে, আর তোর কোন ভাবনা নেই।
গণেশ বললে— তাহলে এক কাজ কর। আমি তো বুড়ী হয়ে গিয়েছি, তুই আমার মেয়েটাকে রাখ। ও টাকা পেলেই আমার পাওয়া হবে— আমি কিছুদিন তীর্থধর্ম করি।
ওর মেয়ে ছিল শান্তি, এতটুকু দেখেছি তাকে। জিজ্ঞাসা করলুম— শান্তি কোথায়? ডাক তো তাকে দেখি একবার।
গণেশ বললে— শান্তি নেই। বছর-কয়েক আগে সে তার ভালবাসার বাবুর সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছে। আমার আর একটা মেয়ে আছে— সে শান্তির চাইতে ভাল দেখতে।
অনুমতিকে দেখেই আমার ভারি পছন্দ হয়ে গেল। কি করি, একদিন গণেশকে কথা দিয়েছিলুম, তা রাখতেই হবে। আমার কাছে বাবা তঞ্চকতা পাবে না। কথার খেলাপ করা কি উচিত। কি বলিস?
বললুম—নিশ্চয় না। বড়দা, আপনি আধুনিক হরিশচন্দ্র। আপনার এই সত্যরক্ষার কথা জগতে প্রচার করবার ভার আমি নিচ্ছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘর আলো করে অনুমতি এল। সুন্দর দেখতে, বয়েস বোধহয় ত্রিশ হবে। দুটি বোতল সঞ্জীবনী, বরফ ও নানা রকমের খাবার-দাবার এল। বড়দা আমাদের সঙ্গে অনুমতির পরিচয় করিয়ে দিলে। সে তক্ষুনি আমাদের নামের পেছনে ‘ঠাকুরপো’ যোগ দিয়ে ডাকতে আরম্ভ করে দিলে— যেন কতকালের ভাব। আর আমরা তার নাম দিলুম- বড়গিন্নী ।
পিতৃবিয়োগের সঙ্গে মানুষের চরিত্র পরিবর্তনের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে বলে বোধ হয়। যে বড়দা সারাদিন কল্পনার রাজ্যে কাটিয়ে দিলে, “লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি”, প্রাসাদ নিমণি, লক্ষ্নৌ থেকে পালিয়ে আসা আত্মগোপনবিলাসী খানসামার দল, সোনার হাঁসের ডিম, মাংসের পুর দেওয়া পরোটা ছাড়া যার কোনো চিন্তাই ছিল না, ত্ৰিশ বছরের মধ্যে পাড়ার হুদ্দো ছাড়া যে বাইরে যায়নি, কোনো কথার প্রতিবাদ করলে খিস্তির ভাষায় যে জবাব দিত, তার এই পরিবর্তন দেখে পিতৃবিয়োগ মানুষের জীবনে একটা মহোপকারী ঘটনা বলে সেদিন মনে হয়েছিল। কারণ, আহার, বিহার ও ব্যবহারে পূর্ব চরিত্রের এমন নিরন্বয় নাশ ইতিপূর্বে আর দেখিনি।
একদিন সন্ধ্যেবেলা অনুমতির আসরে অনুপস্থিত হলে বড়দার তলব পড়ত। —কেন আসিসনি, নিশ্চয় তুই রাগ করেছিস, কেন রাগ করেছিস বল, কে তোকে কি বলেছে, আজ তোর জন্য শ্যাম্পেন অর্ডার দিয়েছি। কি খাবি বল ইত্যাদি— বড়দার আদরের অত্যাচারে অস্থির হয়ে উঠতে হত। প্রতিদিন দু-বোতল মদ আসত, তার এক বোতল বড়দাই খেত। অত নেশার মধ্যেও আমাদের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তার নজর থাকত তীক্ষ্ন। আমাদের মধ্যে যদি কেউ কোনোদিন রাত্রে বড়দার ওখানেই থেকে যাবার বাসনা প্রকাশ করত। তো বড়দা যেন হাতে স্বৰ্গ পেত। তখুনি তার জন্য অল্পবয়স্কা নীরোগ সুশীলা সুন্দরীর খোঁজে পাঁচজন দালাল ছুটত আর সারা রাত্রি ধরে বড়দা নিজে তার তত্ত্বাবধান করত।
এমনি করে সুরা সৌন্দর্য ও সঙ্গীতের স্রোতে আমরা ভেসে চলেছিলুম। পাড়ার কারুর কাছে মুখ দেখাতে পারি না। ছেলে-বুড়ো সকলেই বলে বড়দার মতন অমন লোকটাকে এরা বকিয়ে দিলে। পঞ্চাশোর্ধের লোকে এমনভাবে বয়ে যেতে পারে দেখে পাড়ার বৃদ্ধা ও প্রৌঢ় সধবারা নিজের নিজের ঘর সামলাতে আরম্ভ করলেন।
পাড়ার প্রসন্ন ঘোষ ছিলেন একজন মাতব্বর লোক। তিনি বড়দার ছেলেবেলার বন্ধু। ভদ্রলোকের নামটি যেমন ব্যবহারও তেমনি সদাপ্রসন্ন ছিল। আমরা প্রায়ই সকালে তাঁর বৈঠকখানায় খবরের কাগজ পড়তে যেতুম। তাঁর সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র, খেলাধূলা নিয়ে আমাদের আলোচনা হত এবং তিনি বন্ধুর মত আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। আমরা প্রসন্নবাবুকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতুম এবং তিনি যে আমাদের চাইতে বয়সে অনেক বড়, তুমুল তর্কের মধ্যেও সে কথা কখনো ভুলিনি। একদিন প্ৰসন্নবাবুর বৈঠকখানায় কাগজ পড়তে গিয়েছি, তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই মুখখানা গভীর করে তিনি বাড়ির মধ্যে চলে গেলেন। পাড়ার ছেলেরা তো অভিভাবকদের ভয়ে প্রকাশ্যে আমাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেছিল, মুরুবিবর দল আমাদের দেখলেই মুখ কঠিন করে চলে যেতেন। কিন্তু প্ৰসন্নবাবুর অপ্রসন্ন মুখ দেখে পরদিন সোজাসুজি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলুম— আপনি কি আমাদের ওপরে বিরক্ত হয়েছেন?
প্ৰসন্নবাবু আমতা-আমতা করে বললেন— দেখ হে, আমার স্ত্রী তোমাদের ওপরে ভয়ানক বিরক্ত হয়েছেন। তোমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করি বলে আমাকে বড় গঞ্জনা দেন তিনি। সেইজন্য ঘরের শান্তি বজায় রাখতে তোমাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করতে হয়েছে— তোমরা আর আমার ওখানে যেও না।
বড়দাকে এসব কথা বললে সে বলত—কেন যাস ওদের সঙ্গে সেধে কথা বলতে? ওরা কি আমাদের সঙ্গে মেশবার যুগ্যি!
যাকগে, পাড়ার লোক! আমাদের দিন অর্থাৎ রাত্রিগুলি পরমানন্দে কাটতে লাগল। কিন্তু হঠাৎ একদিন সব বদলে গেল— পরিবর্তনই কালের ধর্ম!
আমাদের নিত্য আড্ডা ছাড়া মধ্যে মধ্যে এক-একদিন বড়দা বড় জলসার আয়োজন করত। সেদিন ভাল ভাল গাইয়ে-বাজিয়ে আসত, আরও দু-একজন আমরা যাকে মনে করতুম তাদের নিমন্ত্রণ করা হত। নাচ, গান, ভূরিভোজন ও পানীয়ে সারারাত্রি কেটে যেত।
একদিন এইরকম একটা জলসার আয়োজন করা হয়েছে। পশ্চিম থেকে একজন বিখ্যাত তবলা-বাজিয়ে এসেছে, সে আসবে; তাছাড়া আরও দু-তিনজন গাইয়ে-বাজিয়ে আসবে —জোর মজলিস হবে।
এইরকম সব মজলিসের দিন বড়দা সকাল দশটার সময় খেয়ে-দেয়ে অনুমতির ওখানে চলে যেত ব্যবস্থা করতে, আর আমরা যেতুম বেলা তিনটে চারটে নাগাদ। সেদিনও বড়দা আমাদের এক-একজনের ওপর এক-একটা কাজের ভার চাপিয়ে দশটার সময় চলে গেল।
বেলা প্রায় তিনটের সময় আমি ও আর একজন অনুমতির বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম। অন্য দু'জনের মধ্যে একজন গিয়েছে বরাহনগরে বড়দাদের বাগানে ফুল আনতে। আর একজন গিয়েছে চন্দননগর থেকে খাঁটি আনতে— কারণ বড়দা শুনেছিল নিমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন চন্দননগরের খাঁটি খেতে ভালবাসে।
অনুমতিদের বাড়িতে তখন হৈ-হৈ চলেছে। নানারকম সুখাদ্যের গন্ধে পাড়া মাত, তার ওপরে চেঁচামেচি- যেন বিয়েবাড়ি। অনুমতি গাছ-কোমর বেঁধে একতলায় কি করছিল, আমাদের দেখেই বললে— কি আক্কেল তোমাদের ঠাকুরপো, এই আসা হল! একলা লোক আমি কতদিক সামলাই বল দিকিন?
বললুম—বড়দা আছে; সে তো একাই একশো।
—আহা তোমাদের বড়দা যা কাজের লোক! দেখি না গিয়ে, সকাল থেকেই বোতল টেনে ট্যা হয়ে আছেন। আমরা দুজন দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি এমন সময় বড়দা টলতে টলতে দরজার কাছে আমাদের দুজনের দুই কাঁধে দু-হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে— এক্ষুনি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চল, আমি বোধহয় আর বাঁচব না।
অ্যাঁ! কি হয়েছে। আপনার?
বড়দা বললে—আমাকে বিষ খাইয়েছে।
বড়দার তখন চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে, আওয়াজ ঘড়ঘড় করছে—
দেখতে দেখতে সে দেহভার সম্পূর্ণরূপে আমাদের ওপর ছেড়ে দিলে।
জিজ্ঞাসা করলাম—কে বিষ খাওয়ালে?
বড়দা ফিশফিশ করে বললে—অনুমতি।
এই বলে সে একেবারে এলিয়ে পড়ল।
আর দেরি করা উচিত হবে না মনে করে আমরা সেই বিরাট দেহ একরকম ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে এলুম। একতলায় অনুমতি, তার মা, ঝি, চাকর ও পাড়ার আরও দু-চারজন মিলে একটা বড় মাছ-কাটা দেখছিল, এমন সময় আমাদের দেখে তারা ছুটে এল— কি হয়েছে —কি ব্যাপার!
—বিষ খেয়েছে!
অনুমতি চীৎকার করে উঠল—ওমা কি হবে! কে বিষ খাওয়ালে?
বললুম — বলছে তো অনুমতি খাইয়েছে।
কথাটা শোনামাত্র উৎসবক্ষেত্ৰ একেবারে শ্মশানক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেল। অনুমতি একটা মারাত্মক চীৎকার করে ঘুরে উঠোনের মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। তার মা গণেশের বৃংহিতে পাড়ার চারিদিক থেকে লোক ছুটে আসতে আরম্ভ করে দিলে। কিন্তু তখন আর দেরি করবার উপায় নেই, বড়দাকে টানতে টানতে গাড়িতে তুলে বললুম— বাড়ি চল। বড়দাকে সেই অবস্থায় বাড়ি নিয়ে গেলে সেখানে ও পাড়ায় অভ্যর্থনাটা কি রকম হবে সে কথা আন্দাজ করেও কেলেঙ্কারির ভয়ে আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলুম না। মিনিট-দশোকের মধ্যেই তাকে বাড়িতে এনে ফেলা গেল। পাড়ায় জনদুয়েক ছোকরা ডাক্তার ছিল, তাদের ডেকে এনে আমরা নীলরতন সরকারকে খবর দিতে ছুটলুম। ডাক্তারের বাড়ি থেকে ফিরে এসে পাড়ার ছেলেদের কাছে শুনতে পাওয়া গেল বড়দাদের বাড়িতে পাড়ার যত মুরুবিবাদের সমাবেশ হয়েছে। সেখানে অবিসম্বাদিত সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, আমরা চারজন অত্যন্ত বদমাইশ ছেলে। বড়দার পতন থেকে আজকের এই মূর্ছা অবধি— সমস্ত ঘটনার জন্য আমরাই প্রধান দায়ী। অতএব ওদের বাড়িতে গেলেই আমাদের প্রহার দেওয়া হবে।
এইসব কথা শুনে আর বড়দাদের ওখানে গেলুম না বটে, কিন্তু তার সংবাদ পাবার জন্য মনটা ছটফট করতে লাগল। রাত্রি প্রায় এগারোটার সময় খবর পেলুম বড়দা ভাল আছে। বিষ-টিষ খাওয়া সব বাজে কথা, কদিন থেকে পেট সাফ হয়নি, তার ওপরে প্রতিদিন ভূরিভোজন ও মদ্যপানের ফলে পেটে বায়ু হয়ে ঐরকম হয়েছিল। পেট পরিষ্কার করে দিতেই তিনি আরাম পেয়েছেন। উঠে বসে ঘণ্টাখানেক লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এখন ঘুমুচ্ছেন।
যাক! নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফেরা গেল।
পরের দিন বড়দার সংবাদ নিয়ে জানলুম যে, সে ভালই আছে, তবে সারাদিন বিছানা থেকে ওঠেনি ও কারুর সঙ্গে কথা বলেনি। ডাক্তার দেখে বলেছে, ভয়ের কোন কারণ নেই, এখন সে উঠে হেঁটে বেড়াতে পারে।
বড়দার সঙ্গে দেখা করবার জন্য আমাদের মন আকুল হচ্ছিল, কিন্তু আমরা বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছিলুম যে, ওদের বাড়িতে গেলে আমাদের অপমান করা হবে। আমরা আশা করেছিলুম যে, বড়দা নিজেই আমাদের ডেকে পাঠাবে, তাহলে কেউ কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু শোনা গেল, সে কারুর সঙ্গে কথা বলছে না, চোখ বুজে পড়ে আছে।
বিকেল নাগাদ শুনলুম, বড়দা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
পরদিন সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি, পাড়ায় হৈহৈ, ব্যাপার লেগে গেছে। ভোর থেকে বড়দাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে জামা-জুতো, টাকা-পয়সা, চাবি সব ফেলে একবস্ত্ৰে কোথায় চলে গেছে। তিরানব্বুই বছরের ঠাকুরমা অজস্রধারায় কাঁদছেন। আর আমাদের অভিশাপ দিচ্ছেন। আমরা রকে এসেছি, এ সংবাদ পেয়ে বড়দার ছেলে ও ভাইরা ও পাড়ার আরও অনেক মুরুব্বি এসে আমাদের আক্রমণ করলে— কোথা গেছে সে বল— নইলে ভাল হবে না।
বড়দার ছোটভাই একখানা চিরকুট দেখিয়ে বললে— বিছানার ওপরে এই চিঠিখানা পড়ে ছিল। দেখলুম বড়দা দেবাক্ষরে লিখে গেছেন—আমি শান্তির অন্বেষণে চলিলাম। বৃথা আমার অনুসন্ধান করিও না।
সবাই মিলে আমাদের চেপে ধরলে— শান্তি কে?
কোনরকমে তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে ছুটলুম অনুমতির বাড়িতে। কিন্তু কোথায় বড়দা! তার চিঠির কথা শুনে গণেশ বললে— হয়েছে। তাহলে পোড়ারমুখে আমার বড়মেয়ে শান্তির সন্ধানে বেরিয়েছে— আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়েছি।
অনুমতি বললে—ওসব পাগল-ছাগল জানি না। আমার নামে যে বদনাম দিয়েছে — দেখা হলে আমি বুঝিয়ে দেব, বলে দিও।
বড়দার বাড়ির লোকেরা একেই আমাদের ওপরে ক্ষেপে ছিল, তার ওপরে অনুমতির বাড়ি থেকে শান্তির খবর নিয়ে এসে বলামাত্র তারা এই মারে তো এই মারে মূর্তিতে আমাদের চেপে ধরলে।
কোথায় শান্তির বাড়ি, বড়দার সঙ্গে তার কিসের সম্পর্ক ইত্যাদি একটি প্রশ্নেরও ঠিকমত জবাব দিতে পারছি না দেখে তারা মনে করলে যে, এ ব্যাপারে সব জেনেও আমরা গোপন করছি। যাহোক, আমরা তাদের কথা দিলুম যে, এক মাসের মধ্যে বড়দাকে খুঁজে বের করবই।
হঠাৎ বিনা কারণে এইভাবে সরে পড়ায় বড়দার ওপরে আমাদের রাগও হয়েছিল। তাকে খুঁজে বের করতে বদ্ধপরিকর হয়ে কাজে নামা গেল। মাস-দুয়েক চেষ্টা করে, বেনারস থেকে নবদ্বীপ অবধি সমস্ত জায়গায় সন্ধান নিয়ে জানলুম যে, সেখানে শান্তি অথবা বড়দা নেই। আমাদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে বড়দা আত্মগোপন করে রইল—কিছুতেই তাকে খুঁজে বের করতে পারা গেল না।
সময়ের চাকা ঠিক ঘুরতে লাগল। দেখতে দেখতে ছ’মাস, একবছর, দু’বছর কেটে গেল, কিন্তু বড়দার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। বড়দার ঠাকুরমা নাতির নাতিদের দল দেখে স্বর্গে গেলেন। বুড়ীর হাতে কিছু টাকা ছিল, মরবার সময় সবাইকে জানিয়ে গেলেন— নগা যদি কোনদিন ফিরে আসে, তবে সেই টাকা যেন তাকে দেওয়া হয়— কিন্তু কোথায় নগা।
বছর-পাঁচেক বাদে একবার উড়ো খবর এল যে, বড়দা সন্ন্যাসী হয়েছে। হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় কারা জানি স্বচক্ষে তাকে সন্ন্যাসীদের সঙ্গে দেখেছে। তার এই সন্ন্যাসী হওয়ার গুজব প্রথমেই রটেছিল, কিন্তু তার মতন লোক স্রেফ নিরাকার শান্তির অন্বেষণে গৃহত্যাগ করবে, সে কথা লোকে তখন বিশ্বাস করতে পারেনি।
দিন যায়, সংসারচক্রে আটকে আমাদের মনেও শান্তি-অন্বেষণের বাসনা মাঝে মাঝে উঁকি দিতে থাকে। আড্ডার সবাই কে কোথায় ছিটকে পড়ল। ন-মাসে, ছ-মাসে কখনো কোনদিন দেখা হয়। অতীত দিনের ইতিহাসপ্রসঙ্গে কখনো হয়ত বড়দার কথা ওঠে, কখনো ওঠে না। কত নতুন লোকের সঙ্গে আলাপ হয়—কাত ‘অনুমতি’, ‘অনুজ্ঞা’ ও ‘আদেশের’ অভিজ্ঞতায় জীবনপাত্র পূর্ণ হতে থাকল, বড়দার স্মৃতি থিতিয়ে পড়ে রইল মনের এক কোণে।
প্রায় দশ বছর পরে এক ফাগুন-সন্ধ্যায় প্রকৃতি তার দক্ষিণদ্বার খুলি-খুলি করছে, সারাদিন কাজে ঘুরে ঘুরে ক্লান্তদেহে বাড়িতে ফিরেই শুনতে পেলুম— বড়দা ফিরে এসেছে। সেখান থেকে দু’বার এসে খবর দিয়ে গেছে।
আর বিশ্রাম করা হল না, তখুনি ছুটিলুম সেখানে।
বড়দাদের বাড়িতে গিয়ে দেখি সদর দরজা থেকে তার ঘর অবধি লোকে লোকারণ্য —সবাই এসেছে সন্ন্যাসী দর্শন করতে। ভিড় ঠেলে ঠেলে ঘরের মধ্যে গেলুম, সেখানেও ভিড়ের অন্ত নেই। সেই পুরানো ঘর, যেখানে যে জিনিসটি ছিল তার কোথাও একটু নড়াচড় হয়নি। দীর্ঘ দশ বছর ধরে বাড়ির লোকেরা প্রতিদিন ঘরখানির নিয়মিত পরিচর্যা করেছে— ঘরের শৌখিন মালিক ফিরে এসে অগোছাল ঘর দেখে অনৰ্থ বাধাবে এই ভয়ে।
ঘরের মধ্যে তীব্র আলো জ্বলছে। দেখলুম, বড়দা মেজেতে কার্পেটের ওপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে রয়েছেন। দুই হাঁটুর ওপর দু-খানা হাত পড়ে আছে। পরনে এক টুকরো সাদা ছোট কাপড় লুঙ্গির মতন পরা, হাঁটুর নীচে নামেনি, বাকি অঙ্গ অনাবৃত।
দেখলুম, বড়দার চেহারার আশ্চর্য পরিবর্তন হয়েছে। দেহ আগের চেয়ে অনেক স্থূল হয়েছে, উজ্জ্বল শ্যামের বদলে দেহের বর্ণ হয়েছে উজ্জ্বল গৌর। মুখ-চোখের কমনীয়তায় বনের পশু ভুলে যায় এমন হয়েছে তার শ্ৰী।
একদল স্ত্রী ও পুরুষ তাঁকে ঘিরে বসে আছে। ভাই, ভাইপো, ভাইঝি, ছেলে ও নাতি-নাতনীরা কেউ বা বসে কেউ বা এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে। এত লোক কিন্তু সকলেই নীরব-স্থিরদৃষ্টিতে তারা বড়দার দিকে চেয়ে আছে, আর বড়দা একভাবে নিম্পন্দ হয়ে বসে— দৃষ্টি তাঁর মাটিতে নিবদ্ধ।
দেখলুম রকের প্রায় সব বন্ধুই আমার আগে এসে জুটেছে। আমাদের প্রসন্ন ঘোষের স্ত্রী সামনেই বসে ছিলেন। আমি ঢুকতেই কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে যেন নীরব ভাষায় বললেন— তুমি আবার এখানে কেন?
আমি সন্ধুচিত হয়ে তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে বন্ধুদের কাছে গিয়ে বসলুম।
কিছুক্ষণ পরে প্রসন্ন ঘোষের স্ত্রী বড়দাকে জিজ্ঞাসা করলেন— বাবা, কতদিন এখানে থাকবেন?
বড়দা কোনো জবাব দিলে না।
কিছুক্ষণ পরে আবার প্রসন্ন ঘোষের স্ত্রী বললেন— যদি দয়া করে এসেছেন। তবে আমায় দীক্ষা দিতে হবে।
বড়দা এবারেও কোনো জবাব দিলে না। ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতাটা থমথমে হয়ে উঠল।
বন্ধুরা ইশারা করে আমায় বললে— প্ৰণাম কর।
সত্যি বড়দাকে তখনো প্ৰণাম করিনি। উঠে গিয়ে তার পায়ে হাত ঠেকিয়ে প্ৰণাম করতেই সে মুখ তুলে চেয়ে আমাকে দেখলে, তারপরে ওপর দিকে ঈষৎ হাত তুলে বললে— নমঃ শিবায়ঃ।
রাত্রি প্রায় এগারোটার সময় আমরা উঠে চলে এলুম। তখনো ঘরের মধ্যে নরনারীর ভিড়ের অন্ত নেই।
পরদিন সকালে বড়দাদের ওখানে গিয়ে শুনলুম যে তিনি তখনো দরজা খোলেননি। রকের বন্ধুরা সবাই নীচের একটা ঘরে বসে আছে। বাইরের লোকও দু-চারজন করে আসছে সন্ন্যাসী দেখতে। কিন্তু তাদের বলে দেওয়া হচ্ছে, এখন দেখা হবে না।
আমাদের মধ্যে বড়দার কথা আলোচনা হতে লাগল। অতীতকালে বড়দা যে-সব কীর্তিকলাপ করেছেন সে সব কথা কি তাঁর মনে আছে?
একজন বললে— অনুমতির কথা একবার জিজ্ঞাসা করলে হয়।
কিন্তু কি করে সেকথা তার কাছে পাড়া যায়। অথচ সেদিনকার সেইসব কার্যকলাপ সম্বন্ধে এখন তার কি মতামত তা জানিবার জন্য আমাদের মনে প্ৰবল আগ্রহ হচ্ছিল। স্থির করা গেল কৌশলে সে কথার ইঙ্গিত করা যাবে। বড়দা যদি কিছু বলে তো বললে, নইলে সেসব কথা চেপে যাওয়াই ভাল।
সন্ধ্যাবেল গিয়ে দেখলুম বড়দার ঘরে নরনারীর ভিড়। কালকের মতন প্ৰসন্ন ঘোষের স্ত্রী সামনেই বসে। আরও দু-চারজন গিন্নিবান্নি গোছের মহিলা সামনে বসে মধ্যে মধ্যে তাকে প্রশ্ন করছেন। বড়দা কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন কখনো বা নীরব থাকছেন। কিন্তু তিনি নীরব থাকলেও প্রশ্নের বিরাম নেই।
প্রসন্ন ঘোষ বড়দার ছেলেবেলার বন্ধু। বোধহয় সেই অধিকারেই তাঁর স্ত্রী বড়দার সঙ্গে কথাবার্তা খুব বেশি বলছিলেন। আজও একবার বললেন— আমায় কিন্তু দীক্ষা দিতে হবে।
বড়দা চুপ।
চুপ করে থাকলে ছাড়ব না— কবে দীক্ষা দেবেন বলুন।
এবার বড়দা বললে— আপনি দীক্ষার জন্য এত উদগ্ৰীব হয়েছেন কেন?
—আমার সংসারধর্ম আর ভাল লাগছে না।
—এতদিন ভাল লাগছিল। আর এখন লাগছে না কেন? কারণ কিছু বুঝতে পেরেছেন?
প্রসন্ন ঘোষের স্ত্রী অশুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন— আপনার অজানা কিছুই নেই। আপনি ইচ্ছা করলে সবই জানতে পারেন।
কথাটা শুনেই বড়দা চোখ বুজে বোধহয় কয়েক সেকেণ্ড পরেই চোখ চাইলেন। বড়দার বড় ছেলের একটা মেয়ে হাঁ করে তাঁর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করলেন— তোমার বাবা কোথায়?
বড় ছেলে অনিল পেছনে ভিড়ের মধ্যে বসেছিল, সে তাড়াতাড়ি ভিড় ঠেলে এসে জিজ্ঞাসা করলে— আমায় ডাকছেন?
—এঁদের একটু বাইরে যেতে বল।
বড়দার কথা শুনে সকলেই উঠে দাঁড়ালেন। তিনি আমাদের দিকে ফিরে বললেন— তোরা বোস।
ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে যাবার পর বড়দা আমাকে বললেন— দরজায় খিল লাগিয়ে দে।
ঘরের মধ্যে রইলুম আমরা চারজন, বড়দা আর ঘোষগিল্পী। বড়দা বললেন— এ আলোটা নিবিয়ে দিয়ে ঐ সবুজ আলোটা জেলে দে।
স্নিগ্ধ সবুজ আলোয় ঘরখানা যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আসন্ন কোনো আশ্চর্য ঘটনার সম্ভাবনায় ঘরখানা থমথম করতে লাগল। আমরা একরকম দম বন্ধ করে বড়দার দিকে চেয়ে রইলুম। দেখলুম বড়দা চক্ষু বুজে নিম্পন্দ পাথরের মূর্তির মতন বসে আর ঘোষগিন্নী আকুল নয়নে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছে। বড় বড় দু ফোঁটা অশুধু তাঁর দু চোখে ডবডব করছে।
প্রায় পনেরো মিনিট এইভাবে কাটবার পর বড়দা চোখ খুলে ঘোষগিন্নীকে বললেন— এখানে আমার পাশে এসে বোসো।
ঘোষগিল্পী মন্ত্রচালিতের মত বড়দার বা পাশে গিয়ে বসলেন। তারপরে বড়দা বাঁ হাত দিয়ে গভীর আলিঙ্গনে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। ঘোষগিন্নীও কোনো বাধা না দিয়ে সে আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণ করলেন। সেখানে আমরা যে কজন বাইরের লোক বসে আছি সে জ্ঞানও তাঁর যেন নেই।
আমাদের মনে হতে লাগল বড়দা এবার এমন একটা কেলেঙ্কারি করবে যার ফলে আমাদের দেশত্যাগী হওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর থাকবে না। পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি এমন সময় দেখি ঘোষগিন্নীর মুখখানা বড়দার বাহুমূলে হেলে পড়েছে আর তিনি তাঁর কানে ফিসফিস করে কি বলছেন।
সমস্ত ব্যাপারটা ঘটতে বোধহয় পাঁচ মিনিট সময়ও কাটেনি। হঠাৎ ঘোষগিন্নী চীৎকার করে একবার দাঁড়িয়ে উঠেই দড়াম করে পড়ে গিয়ে গোঁ-গাঁ করে আওয়াজ করতে আরম্ভ করে দিলে। বড়দা তাঁর মাথাটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে নিজের উরুতে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ঘোষগিন্নীর দেহটা কাটা ছাগলের মতন থরথর করে কাঁপতে লাগল।
ব্যাপার দেখে আমাদের মধ্যে একজন উঠে গিয়ে দরজা খোলবার চেষ্টা করতেই বড়দা ইঙ্গিতে তাকে বারণ করলেন। তাঁর হাসিহাসি মুখখানা দেখে আমার মনে হতে লাগল সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে কি যেন এক রহস্য লুকিয়ে আছে।
যাহোক আধঘণ্টা এইরকম নীরবে কাটার পর ঘোষগিন্নী তো উঠে বসলেন। বড়দা জিজ্ঞাসা করলেন— কেমন আছ? ঘোষগিন্নী কথা না বলে ঘাড় নেড়ে জানালেন যে তিনি ভালই আছেন।
বড়দা তাঁকে বললেন— কাল ঘুম থেকে উঠে ভোরবেলা স্নান করে আমার কাছে আসবে, তোমাকে কিছু বলব। সারাদিন থেকে রাতে চলে যেও— খাওয়া-দাওয়া এখানেই করবে।
ঘোষগিন্নী ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন।
বড়দা আমাদের দিকে ফিরে বললেন— যা তোরা এঁকে বাড়ি পৌঁছে দে।
দরজা খুলে দেখা গেল বাইরে আগের চাইতে বেশি ভিড় জমেছে, দরজা খুলতেই তারা হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকতে লাগল। আমরা সেই ভিড় ঠেলে প্রসন্নবাবুর স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে এলুম।
সেদিন রাত্রে আমরা দু-তিনজন পরামর্শ করে ঠিক করলুম। যে বড়দার কাছে দীক্ষা নেব। ঠিক হল কালই দীক্ষার কথা প্ৰস্তাব করা যাবে, কি জানি বড়দা যে রকমের লোক হয়ত একদিন সকালবেলা দেখা যাবে কোথাও উধাও হয়েছে।
পরদিন বেলা দশটার সময় কাজে বেরুচ্ছি এমন সময় বাড়ির দরজার কাছেই একজন হিন্দুস্তানী চাকর গোছের লোক আমাকে অভিবাদন করে বললে—আপনি একটু ঐ গলির মধ্যে দয়া করে চলুন—বিবি ডাকছেন।
চমকে উঠলুম! বিবি ডাকছে কি রে বাবা! কে তোমার বিবি?
—আজ্ঞে অনুমতি বিবি।
আর বেশি কিছু বলতে হল না। গুটিগুটি তার সঙ্গে চললুম। বাড়ির কাছেই নির্জন এক গলির মধ্যে একখানা দরজা জানালা বন্ধ সেকেণ্ড ক্লাস গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। লোকটা গাড়িখানা দেখিয়ে বললে—ওর মধ্যে আছে।
আশেপাশে চারিদিকে ভাল করে নিরীক্ষণ করে গাড়ির দরজাটা খুলে দেখি সত্যিই ভিতরে অনুমতি বসে আছে। আমাকে দেখে সে টপ করে আমার একখানা হাত ধরে বললে—এস এস, ভেতরে এস।
গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করামাত্র গাড়ি চলতে লাগল। কোনোরকম গৌরচন্দ্ৰিকা না করে অনুমতি সোজা আমায় প্রশ্ন করলে—পোড়ারমুখো নাকি ফিরে এসেছে?
ন্যাকা সেজে বললুম—কে?
—কে আবার, তোমাদের বড়দা।
—হ্যাঁ।
—আমার সঙ্গে একবার দেখা করিয়ে দিতে পার? একবার জিজ্ঞাসা করব, গেলি গেলি আমার এ সর্বনাশ করে গেলি কেন?
—তোমার আবার কি সর্বনাশ হল?
—সর্বনাশের বাকি কি রাখলে! বিষ-খাওয়ানর বদনাম দিয়ে চলে গেলা— মনে নেই?
সেদিনের কথা মনে পড়ে হাসি পেতে লাগল। অনুমতি আমার মুখ দেখে বললে— তুমি হাসচ ঠাকুরপো! আমার অবস্থাটা একবার ভেবে দেখ! সেই থেকে লোকে আমার নাম দিয়েছে—‘বিষে মতি’। লোকে আমার কাছে আসতে ভয় করে, বলে— বাবা, বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে। এই বুড়ো বয়সে আমি কি করি বল তো। আমি শুধু একবার পোড়ারমুখোকে জিজ্ঞাসা করব— কি দোষে আমার এমন অপবাদ দিয়ে গেলি?
আমি বললুম—তা তুমি গিয়ে দেখা করলেই তো পার। দুনিয়ার লোক তো দিনরাত তাকে দেখতে যাচ্ছে।
অনুমতি বললে—তুমি তাহলে তাকে বলে রেখ। কাল সন্ধ্যেবেলা আমি যাব। বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করা গেল— কি করা যায়! ঠিক হল কথায় কথায় একবার অনুমতির অবতারণা করা যাবে। বড়দা যদি সায় দেয় তখন বলা যাবে যে, সে একবার দেখা করতে চায়।
রাত্রে বড়দার ওখানে গিয়ে শুনলুম। সকালে ঘোষগিন্নী আসার পর বড়দা সেই যে দরজা বন্ধ করেছিলেন, এই খানিক আগে খুলেছেন। সন্ধেবেলা অনেক লোকজন এসেছিল, কিন্তু তিনি বলে দিয়েছেন আজ আর কারুর সঙ্গে দেখা হবে না। দরজা খোলা আছে শুনে আমরা দোতলায় উঠে বড়দার ঘরে ঢুকলুম। দেখি বড়দার সামনে ঘোষগিন্নী বসে আছেন, আর তিনি কি বলে যাচ্ছেন। ঘরের মধ্যে স্নিগ্ধ সবুজ আলো, বড়দার কণ্ঠস্বর তার চাইতেও স্নিগ্ধ বলে মনে হতে লাগল।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি দেখে বড়দা বললেন —আয় বোস।
বড়দা বলে যেতে লাগলেন— অর্থ, প্রতিপত্তি ও যৌনলিন্সা— এই তিনটি হচ্ছে যোগের প্রধান বাধা। অর্থ ও প্রতিপত্তির মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করা অপেক্ষাকৃত সহজ, কিন্তু যৌনলিন্সা মানুষের মৃত্যুদিন অবধি প্ৰবল থাকে। এই আকাঙ্ক্ষাই অধিকাংশ জীবকে বারে বারে এখানে টেনে নিয়ে আসে। এইজন্যই অধিকাংশ যোগীই গৃহত্যাগ করে সংসারের বাইরে গিয়ে নির্জনে সাধনা করেন।
ঘোষগিন্নী বললেন—কিন্তু গৃহস্থ হয়েও তো ব্ৰহ্মনিষ্ঠ হওয়া যায়!
বড়দা বললেন—তা কেন হওয়া যাবে না। সংসারে ব্রহ্মনিষ্ঠ চোর-জোচ্চোরও দুর্লভ নয়। ব্ৰহ্মনিষ্ঠ হওয়া আর যোগী হওয়া এক নয়। আমাদের দেশে আগে ব্ৰহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থরা বানপ্ৰস্থ অবলম্বন করতেন, সেখান থেকে আবার প্রব্রাজ্য গ্রহণ করতেন। যোগী হতে হলে দেহ ও মনের সমস্ত কামনাই ত্যাগ করতে হয়।
দেখলুম বড়দার মেজাজটা বেশ খুশীই আছে। অনুমতির কথাটা এইবার পাড়ব কি না ভাবছি। এমন সময় ঘোষগিন্নী বললেন—আপনি আর যাবেন না, এইখানেই থাকুন।
ঘোষগিন্নীর কথা শুনে বড়দা হেসে ফেললে। তার হাসি ছিল অদ্ভুত। কোনো রকম শব্দ না করে হাসতে থাকত আর কাঁধ, পিঠ ও পেট সেই সঙ্গে থারথার করে কাঁপতে থাকত। হাসি থামতে বড়দা বললে—এখানে কি ক’রে থাকি। যদি মরে যাই তো, গেরস্তর অকল্যাণ হবে—ফেলবে কে?
নগেন অর্থাৎ বড়দার ভূতপূর্ব মিতে বললে—আমরা থাকতে আপনাকে ফেলবার ভাবনা হবে না—সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
বড়দা আবার সেই রকম ক’রে হাসতে আরম্ভ ক’রে দিলে। কিছু পরে বললে—যদি বলি কেওড়াতলায় পুড়িব তা হলে নিয়ে যেতে পারবি এই স্থূল দেহকে।
—নিশ্চয় পারব বড়দা—আপনি সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন।
বড়দা আবার হাসতে আরম্ভ করলে। সমস্ত আলোচনা অন্য পথ ধরে চলতে আরম্ভ করল, কিছুতেই আমার কথাটা আর পাড়তে পারি না। শেষকালে জোর ক’রে অন্য প্রসঙ্গের মাঝখানে আমি বললুম—বড়দা, যদি অনুমতি করেন তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। বড়দা বললে—বল।
ঘোষগিন্নী উপস্থিত থাকায় কথাটা সোজাসুজি বলতে পারছিলুম না বলে ঘুরিয়ে বললুম—কিন্তু দেখলুম বড়দা কিছুই বুঝতে পারলে না। অথচ প্রশ্ন ক’রে চুপ করে থাকতে পারি না। ভেবে চিত্তে বলা গেল—আচ্ছা সত্য উপলব্ধি করতে হলে কি গুরুর প্রয়োজন হয়, না, ধর্মগ্রন্থ পড়তে পড়তে সত্য উপলদ্ধি হয়।
বড়দা বললে—না, গুরু কিংবা ধর্মগ্রন্থ এ দুয়ের কেউই সত্য দিতে পারে না। প্রথমে সত্যের জন্য অন্তরে জাগে আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা স্বতঃস্ফুর্ত হয়, এই আকাঙ্ক্ষাই সত্যের প্রথম প্রকাশ—মধ্যাহ্নের আগে যেমন উষার প্রকাশ—এ আপনিই আসে। এর সম্বন্ধেও বলা যেতে পারে ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন।
এই বলেই বড়দা ধর্ম, দর্শন, ঈশ্বর ও ব্রহ্মের সব জটিল তত্ত্বের ব্যাখ্যা আরম্ভ করে দিলে। একের পর এক আসতে লাগল, প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের অঙ্গাঙ্গি সম্বন্ধ। সেই কথা-সমুদ্রের ঢেউ একটার পর একটা এসে আমার জ্ঞান ও বুদ্ধির মূলে আঘাত করতে করতে আমাকে স্থান ও কালের বাইরে এনে ফেললে। আমি যেন স্পষ্ট দেখতে লাগলুম, বড়দা গত জীবনের সমস্ত গ্লানি ও মালিন্য কাটিয়ে দীপ্ত ভাস্করের মতন প্রভান্বিত ও তার চতুর্দিকে সেই পুরানো দিনের সোনার হাঁসের ডিম, কুবের ভাণ্ডার, লাফানে কই, অনুমতি, গণেশ ও আমরা সবাই গ্ৰহ-উপগ্রহের মতন ঘুরছি। হঠাৎ চটকা ভেঙে দিতে দেখলুম বড়দা সেই রকম ক’রে হাসছে আর সবাই আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে।
বড়দা জিজ্ঞাসা করলে—কি রে, ঘুমিয়ে পড়েছিলি? নিজেকে সামলে নিতে নিতে বললুম না বড়দা, ঘুমুই নি। একটা কথা আপনাকে বলব বলব করে বলতে পারছি নে।
—সে তো বুঝতে পারছি—তা বল না।
—আজ সকালে অনুমতি এসেছিল আমার কাছে।
—কেন?
—সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। কাল সন্ধ্যের সময় আসবে বলেছে।
বড়দা আবার সেই রকম করে হাসতে আরম্ভ করে দিলে। ঘোষগিন্নী জিজ্ঞাসা করলেন—অনুমতি কে?
বড়দা বললে—আমার পূর্ব জীবনের একটি বিশিষ্ট বন্ধু।
তারপরে আমায় বললে—দেখা করতে চেয়েছিল তো আজই নিয়ে এলি না কেন! পড়িসনি— কালকের জন্য কোনো কাজ ফেলে রাখতে নেই।
—সেই বললে যে কাল আসব, তাই।
‘ও’ বলে বড়দা হাসতে হাসতে পাশের একটা বড় তাকিয়া নিয়ে হেলে পড়লেন। ঘোষগিন্নী পায়ে হাত বুলোতে লাগলেন।
বড়দা শুয়ে শুয়ে নানা কথা বলতে আরম্ভ করলেন। সে-সব সাংসারিক কথা, তাঁর পুরানো জানাশোনা লোকেরা কেমন আছে ইত্যাদি। হঠাৎ একবার আমায় বললেন—কাল অনুমতি আসবে—না রে?
—হ্যাঁ। বড়দা হাসতে আরম্ভ করলেন। তাঁর সবাঙ্গ থারথার করে কাঁপতে লাগল। হাসি থেমে যাওয়ার পর মিনিট-পাঁচেক সব স্থির নিস্তব্ধ। একবার ঘোষগিন্নী বললেন—পাটা যেন অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে।
নগেন বড়দার একখানা হাত ধরে আঙুলগুলো টেনে দিচ্ছিল। সে ডাকলে— বড়দা বড়দা।
কোনো সাড়া নেই।
ধাক্কা দিয়ে তাকে চিত করা হল। হিম নিঃসাড়া অঙ্গ, বুকে কান দিয়ে দেখলুম, ধুকধুকুনি থেমে বন্ধ হয়ে গেছে।
ছুটে বাইরে গিয়ে ডাকাডাকি করতেই বাড়ির সবাই দৌঁড়ে এল। মিনিট-দশোকের মধ্যেই দু-তিনজন ডাক্তার এসে পড়ল। তারা পরীক্ষা করে বললে প্ৰাণপাখি উড়ে গেছে।
এবার বড়দা কোথায় গেল।
বর্ষ ১১ সংখ্যা ৪৮-৫১|২৮ আশ্বিন : ৪.১১.১৮ কাৰ্তিক ১৩৫১/১৪.২১.২৮ অক্টোবর : ৪ নভেম্বর ১৯৪৪