দরজা ঠেলে বসের অফিসে উঁকি দিল পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিটেকটিভ তরুণ, সুদর্শন যুবক ইন্সপেক্টর ইউসুফ পাশা। ‘আমায় ডেকেছেন, স্যার?’
ডেস্কে রাখা কাগজের স্তূপ থেকে মুখ তুললেন এসপি তারিক ওসমান। ‘ও, হ্যাঁ, ইউসুফ, এসো।’
জুলফির কাছের চুল সাদা হয়ে এসেছে এসপির। চাঁদির চুল পাতলা। মোটা ভুরু নাচিয়ে ইঙ্গিতে চেয়ার দেখালেন, ‘বোসো।’
বসল পাশা।
‘একটু আগে ওমর আলি এসেছিল’, এসপি বললেন। ‘ইন্সপেক্টর, কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ। চেনো নিশ্চয়?’
‘চিনি, স্যার। কোনো সমস্যা?’
‘হ্যাঁ, সমস্যাই। চা খাবে?’
‘না, স্যার। খেয়েই বেরিয়েছি।’
হাতের সামনের ফাইলগুলো ঠেলে সরালেন তারিক ওসমান। চেয়ারে হেলান দিলেন। ‘এমন একটা সমস্যায় পড়েছে ওমর আলি, যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও আসলে সহজ নয়। যাদের কথা বলতে এসেছে, তারা কলকাতার অভিজাত এলাকায় থাকে, বালিগঞ্জে। তাদের একজন একটা সুন্দরী মেয়ে, নাম জয়িতা সুলতানা, কলকাতার একটা নাইট ক্লাবের নর্তকী। স্বাভাবিকভাবেই তার অনেক বন্ধু আছে, তাদের একজনের নাম লিয়াকত হোসেন, মাঝবয়সী ব্যবসায়ী, সোনা আর রত্নপাথরের ব্যবসা করে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। সে নিজে থাকে কলকাতায়, তার এক ভাই আমির হোসেন থাকে ঢাকায়, এখানকার ব্যবসাটা দেখাশোনা করে। বেশ কিছুদিন ধরে ওদের নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে ওমর আলি, ঢাকা তো বটেই, কলকাতায়ও খোঁজ নিয়েছে।’
‘এই লেডি নিশ্চয় বেড়াতে আসেন আমাদের দেশে।’
ভুরু কোঁচকালেন এসপি, ‘তুমি কী করে জানলে?’
‘অনুমান, স্যার।’
‘মেয়েটা বেশ ঘন ঘনই আসে’, জবাব দিলেন এসপি। ‘প্রথমবার এসেই ওমর আলির নজরে পড়ল। কাস্টমসকে জানাল ঢাকায় ছুটি কাটাতে এসেছে। কলকাতার নেতাজি সুবাস চন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটা প্লেনে চড়ে এসে নামল ঢাকার হজরত শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। কলকাতা টু ঢাকা। তার মানে বুঝতেই পারছ ঘটনাটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। মেয়েটার সঙ্গে ছিল ঢাকার বন্ধুদের জন্য নানা রকম উপহার আর ছোট এক বাক্স রত্নপাথর। কাস্টমস পেরোনোর সময় নিজে থেকেই জিনিসগুলোর কথা জানাল মেয়েটা, আবগারি শুল্ক মিটিয়ে দিল।’
‘বাহ্!’ পাশার চোখে আলোর ঝিলিক।
‘প্রথমবার ঢাকায় এক সপ্তাহ থাকল মেয়েটা। সবচেয়ে দামি হোটেল, সবচেয়ে দামি স্যুইট—আগে থেকেই বুক করা ছিল। দামি একটা গাড়ি দেওয়া হলো তাকে চলাফেরার জন্য। এসব বিলাসিতা দেখে সন্দেহ হলো ওমর আলির—এত টাকা কোথায় পায় সাধারণ একজন ক্যাবারে ড্যান্সার? মাস তিনেক পরে আবার যখন এল মেয়েটা, সঙ্গে দুটো আনকাট ডায়মন্ড নিয়ে, সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করল ওমর আলি।’
‘এই হিরাগুলোর কথাও নিশ্চয় নিজে থেকেই কাস্টমসকে জানিয়েছে জয়িতা?’
‘হ্যাঁ। টুঁ-শব্দ না করে শুল্ক মিটিয়ে দিল। এটাও সন্দেহজনক, কারণ পাথরগুলো এতই ছোট না জানালেও চলত, কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে হয়তো বেরিয়ে চলে যেতে পারত। এ থেকে বোঝা যায় মেয়েটা অপেশাদার। এরাই অতি সততার ভান করে। কিন্তু পোড় খাওয়া কাস্টমস ইন্সপেক্টর ওমর আলিকে ফাঁকি দিতে পারল না। তার সন্দেহ চরমে উঠল। দ্বিতীয়বার জয়িতা দশ দিন থাকল। আগেরবারের মতোই বিলাসবহুল স্যুইট, দামি গাড়ি, দামি রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়া—মোটকথা ইচ্ছামতো টাকা ওড়ানো। এসব দেখে ওমর আলি বুঝল, তদন্ত শুরু করা দরকার।’
‘এখনো করছে?’
‘চোখকান খোলা রাখছে।’
ধীরে ধীরে হাসি ছড়িয়ে পড়ল পাশার মুখে, ‘তার মানে আবারও ঢাকায় এসেছে জয়িতা?’
‘চলেও গেছে।’
‘তাহলে আর আমাকে কী দরকার?’
‘দরকার আছে বলেই ডেকেছি’, অধৈর্য ভঙ্গিতে বললেন এসপি। ‘সুন্দর মুখের ভুবনভোলানো মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে কাস্টমস অফিসারকে কুপোকাত করে নির্ধারিত শুল্ক মিটিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। তবে ওমর আলি হাসি দেখে পটেনি। মেয়েটার স্যুটকেস তল্লাশি করে কিছুই পায়নি। তল্লাশির সময় চটেনি বরং সহযোগিতা করেছে জয়িতা। তার স্যুটকেসের যা হাল করেছে কাস্টমস, অন্য কেউ হলে রাগে লাফাত। অথচ মেয়েটার হাসিটাও নাকি মলিন হয়নি। মহা হতাশ হলো ওমর আলি। সে বুঝতে পারছে, মেয়েটা তাকে ধাপ্পা দিচ্ছে, কিন্তু কীভাবে, ধরতে পারছে না। রাগের চোটে শেষে ওর দেহ তল্লাশিও করিয়ে ছেড়েছে। আর যারা করেছে, তারা এ কাজে বিশেষজ্ঞ।’ একটু থেমে এসপি বললেন, ‘যা-ই হোক, আমারও প্রশ্ন, একজন সাধারণ নর্তকী হয়ে এত টাকা কোথায় পায় মেয়েটা?’
‘হয়তো তার রত্ন ব্যবসায়ী কোটিপতি বন্ধু দেয়।’
‘দিতে পারে। প্রেমে পড়লে বয়ফ্রেন্ডরা গার্লফ্রেন্ডদের জন্য কত কিছুই করে!’
‘সরি, স্যার। আমার আর গার্লফ্রেন্ড নেই, তাই কী কী করে আমি বলতে পারব না।’
মুচকি হাসলেন এসপি। ‘বিয়ে করো না কেন?’
‘করলেই কী? বউ তো আর গার্লফ্রেন্ড নয়, স্যার।’
‘নাহ্, তোমার সঙ্গে কথায় পারা যায় না। ওপরওয়ালাকে কীভাবে সমীহ করে কথা বলতে হয়, তা-ও জানো না।’ হঠাৎ ধমকে উঠলেন, ‘কিন্তু ঢাকায় কেন?’
‘মানে, স্যার?’
‘সহজ কথাই তো বললাম। যানজট, রাস্তা কাটা, গিজগিজে মানুষ বেড়ানোর জন্য পৃথিবীতে কি জায়গার এতই অভাব পড়ে গেল?’
একটু দ্বিধা করে পাশা বলল, ‘ঢাকায় থাকতে আমার কিন্তু খারাপ লাগে না, স্যার।’
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন এসপি।
আমতা আমতা করে পাশা বলল, ‘তা, আমাকে কী করতে হবে, স্যার?’
‘মেয়েটাকে অনুসরণ করতে হবে।’
‘চলে গেছে, বললেন না?’
‘ওমর আলি খবর পেয়েছে, আবার আসবে। আগামী শনিবারের অগ্রিম টিকিট কেটেছে বাংলাদেশ বিমানে। তাতে এক সপ্তাহ সময় পাচ্ছ তুমি।’
‘আপনি বলতে চাইছেন, আমি কলকাতা যাই, মেয়েটার ওপর নজর রাখি, তারপর একসঙ্গে বিমানে উঠি?’
‘এই তো বুঝেছ’, হারিয়ে যাওয়া হাসিটা ফিরে এল তারিক ওসমানের। ‘তোমাকে জানতে হবে, স্মাগলিংটা সে কীভাবে করে, কার সাহায্যে।’
অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে পুরু কাচে ঢাকা টেবিলে কয়েকবার মৃদু টোকা দিল পাশা, ‘এটা তো আমাদের কাজ নয়, স্যার...’
‘ধরা যাক, অনুরোধের ঢেঁকিই গিললে’, বাধা দিয়ে বললেন এসপি। ‘আজ রাতের ফ্লাইটেই কলকাতা যাচ্ছ তুমি। ওখানে ওমর আলির থাকবে, সব রকম সহযোগিতা পাবে। বিমানে তোমার সিটটা যাতে সাত নম্বর সিটের খুব কাছাকাছি হয়, সে ব্যবস্থাও করা হবে।’
‘সাত নম্বর কেন, স্যার?’
‘এটাই জয়িতার পছন্দের সিট। সাত নম্বর ছাড়া অন্য কোনো সিটে সে বসে না। সিট না পেলে যত দিন দরকার, অপেক্ষা করে।’
‘কেন?’
‘হয়তো কুসংস্কার। ভাবে, সাত নম্বরটা তার জন্য শুভ।’
২.
পরের শনিবারে, বাংলাদেশ বিমানের রাতের ফ্লাইটে জয়িতাকে অনুসরণ করল পাশা। তার সামনের সিটটাই সাত নম্বর। মেয়েটাকে দেখছে। সত্যিই চোখে পড়ার মতো সুন্দরী। কোঁকড়া চুল, মিষ্টি চোখ, মিষ্টি হাসি। রাগ নেই। সন্দেহ করার কোনো সুযোগই নেই, একমাত্র খরচের বহরটা ছাড়া। এই যেমন, এখন যে শাড়িটা পরে আছে, তার দাম লাখ টাকা। সত্যিই তো, সাধারণ একজন নর্তকী এত টাকা কোথায় পায়?
কলকাতা বিমানবন্দরের ওয়েইটিং লাউঞ্জ থেকেই তার ওপর নজর রাখছে পাশা। আরও কিছু যাত্রী উঠেছে বিমানে। প্রায় সবাই বাংলাদেশি। বেশির ভাগই চিকিৎসা নিতে গিয়েছিল কলকাতায়। ট্যুরিস্টরা এই ঝড়বৃষ্টির দিনে বেড়াতে যায় না। যাত্রীদের কারও সঙ্গেই কথা বলল না। এমনকি আকারে-ইঙ্গিতেও প্রকাশ করল না, কেউ তার পরিচিত। এটাই আশা করেছিল পাশা। এত বোকামি করবে না জয়িতা। যে কজন টিকিট কেটেছে, তাদের ব্যাপারেও কলকাতায় থাকতেই খোঁজখবর করেছে পাশা। তাদের কারও সঙ্গেই কখনো জয়িতাকে দেখা যায়নি।
এয়ার হোস্টেসের দেওয়া নাশতা সাদরে গ্রহণ করল সে। কোনো দিকে তাকাল না, যেন দুনিয়ার কোনো কিছুর প্রতি আগ্রহ নেই—খাবার, বই পড়া আর চুইংগাম চিবানো ছাড়া। খেতে খেতেও গল্পের বই পড়ছে। তবে এই সময়টা চুইংগাম খাওয়া বন্ধ রেখেছে। খাওয়ার মাঝে একবার মাত্র হোস্টেসকে ডাকল, কোকাকোলা দেওয়ার জন্য। যাত্রার শুরু থেকেই চুইংগাম চিবোচ্ছে। তবে নাশতা খাওয়ার সময়টা বাদ রাখল। কিন্তু এতে কিছু বলার নেই। অস্বাভাবিক কিছু নয়। চুইংগাম চিবানো অনেকেরই প্রিয়।
কলকাতা থেকে ঢাকার দূরত্ব খুবই কম। তাই মাঝখানে কোথাও ল্যান্ড করল না বিমান। সোজা চলে এল ঢাকার কাছাকাছি।
অবাক লাগছে পাশার। হতাশও লাগছে। কারণ, তাকে যে উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছিল, সেটা বোধ হয় ব্যর্থ হতে চলেছে। ওমর আলির অনুমান মনে হয় সঠিক নয়। আর মেয়েটা যদি বেআইনি কিছু করেই থাকে, সেটা এতই চতুরতার সঙ্গে, যা কারও ধারণারও বাইরে। কিংবা পাশাকে আগেই সন্দেহ করে ফেলেছে জয়িতা, তাই এবারের ট্রিপে আর চোরাই মাল বহন করছে না।
বিশাল যন্ত্রদানবটা যখন এয়ারপোর্টের রানওয়েতে ল্যান্ড করল, দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল পাশার কপালে। বিমানটা রানওয়ে ধরে দৌড়ে গিয়ে ঘুরে এসে থামল। যাত্রীরা নামতে শুরু করল। মেয়েটাও সাবলীল ভঙ্গিতে নেমে গেল সবার সঙ্গে। অস্বাভাবিক কিছুই করল না। পাশা জানে, বাইরে পুলিশ নিয়ে তৈরি হয়ে আছে ওমর আলি। পাশার ইঙ্গিত পেলেই জয়িতাকে গ্রেপ্তার করবে।
প্লেন থেকে নেমে গেল সবাই। সারি দিয়ে কাস্টমসের দিকে এগোচ্ছে। পাসপোর্ট দেখানো আর অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর উদ্দেশ্যে। পাশার কাছে দৌড়ে এল ওমর আলি, ‘কিছু দেখেছ?’
‘না’, জবাব দিল পাশা। ‘মেয়েটা কারও সঙ্গে কথা বলেনি। সিট থেকে একবারের জন্যও নড়েনি। বেআইনি কোনো কিছুই করেনি। আই অ্যাম সরি, ওমর।’
প্রচণ্ড হতাশ হয়ে কাউন্টারের দিকে দৌড়ে চলে গেল ওমর আলি।
হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই থমকে দাঁড়াল পাশা। তাই তো! এই সহজ কথাটা মাথায় আসেনি! তাড়াতাড়ি তাকাল বিমানটার দিকে। পাইলট আর ক্রুরা তাদের ব্যাগ আর জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাচ্ছে। যাত্রীসহ নিরাপদে জায়গামতো পৌঁছে দিয়েছে প্লেন। তাদের ডিউটি শেষ।
মেইনটেন্যান্স কর্মীরা এসে হাজির হলো, সদ্য উড়ে আসা এয়ারক্র্যাফটটার পরিচর্যা করার জন্য। ওদের সঙ্গে রয়েছে কোঁকড়াচুলো সুন্দরী এক মেয়ে। জয়িতার সঙ্গে চেহারার মিল আছে। জয়িতার মতোই একনাগাড়ে চিবোচ্ছে চুইংগাম। হাতে পোকামাকড় মারার ওষুধ, আর স্প্রে করার যন্ত্র। বিমানের ভেতরে গিয়ে ওষুধ ছিটাবে—মশা বা অন্যান্য ক্ষতিকর পোকা যাতে মরে যায়—যাত্রীদের মারাত্মক রোগে সংক্রমিত করতে না পারে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল পাশা। মেয়েটাকে বিমানের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে দেখে মুচকি হাসল। জয়িতা আর এই মেয়ে—দুজনের চেহারার মিল, একইভাবে চুইংগাম চিবানো, বড় বেশি কাকতালীয়। কেন যে ওমর আলির চোখে পড়ল না!
দ্রুত বিমানের দরজার দিকে এগিয়ে গেল পাশা। নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঢুকে গেল ভেতরে। মেয়েটাকে দেখল, সাত নম্বর সিটের কাছে উবু হয়ে কী যেন করছে।
আবার বাইরে বেরিয়ে এল পাশা। দেখল, সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছে ওমর আলি। পাশাকে না দেখে ঠিকই এসে হাজির হয়েছে।
পাশা নিচে নামতেই ওমর আলি বলে উঠল, ‘নাহ্, এবারও কিছু পেলাম না! মেয়েটা আবারও আমাদের ফাঁকি দিল। কয়েকটা সাধারণ রত্নপাথর ছাড়া কিছুই নেই তার কাছে। আমার মাথায় ঢুকছে না, এত সাধারণ জিনিসের কথা এত ঘটা করে জানানোর মানেটা কী?’
‘অবশ্যই আমাদের নজর অন্যদিকে সরিয়ে রাখার জন্য’, জবাব দিল পাশা। ‘একটা মেয়ে, বিমানের পরিচর্যাকর্মী, জয়িতার সঙ্গে চেহারার মিল, কোঁকড়া চুল, সারাক্ষণ চুইংগাম চিবায়। চেনো তাকে?’
‘হ্যাঁ, রিনিতা। প্লেনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করে। সে আবার কী করল?’
‘চলো, দেখি কাজটা কত দক্ষভাবে সারে সে’, আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল পাশা।
লাফ দিয়ে সিঁড়িতে উঠে পড়ল ওমর আলি, ‘কী বলতে চাও?’
‘চুইংগাম খুবই কাজের জিনিস’, পাশা বলল। ‘শুনেছি, আগেকার দিনে আকাশে প্লেনের তেলের ট্যাংকে লিক ধরা পড়লে, চুইংগাম চিবিয়ে সেটা দিয়ে ফুটো বন্ধ করত পাইলটরা।’
‘এর সঙ্গে স্মাগলিংয়ের সম্পর্ক কী?’
‘সম্পর্কটা এখনো ধরতে পারছ না?’
‘পাশা, দোহাই লাগে তোমার...’ বলতে বলতে থেমে গেল ওমর আলি। তাকাল ওপরের দিকে।
দরজার কাছে চলে এসেছে মেয়েটা।
‘এক্সকিউজ মি, ম্যাডাম, আপনার সাথে আমার একটু কথা আছে!’ পাশা বলল।
চুইংগামের দলাটা গালের এক পাশে সরিয়ে নিয়ে রিনিতা বলল, ‘বলুন?’
‘আপনি মনে হয় চুইংগাম খুব পছন্দ করেন?’
মেয়েটার ফরসা মুখ থেকে খানিকটা রক্ত সরে গেল, ‘কী বলতে চান?’
‘ভাবছি, মিস জয়িতা আপনার কিছু হন কি না?’
একটু দ্বিধা করে জবাব দিল মেয়েটা, ‘হয়। আমার যমজ বোন। আমার বড়। কেন?’
‘না, একইভাবে চুইংগাম চিবান তো তিনিও,’ পাশা বলল। ‘ব্র্যান্ডও কি এক?’
‘এক। আপাই কলকাতা থেকে এনে দেয়।’
‘গুড। মুখের ভেতর যে দলাটা আছে, একটু দেখতে পারি?’ হাত বাড়াল পাশা, ‘আমি পুলিশের লোক।’
রক্ত যা-ও বা খানিকটা ছিল রিনিতার মুখে, তা-ও সরে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বুঝল, আর ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই।
‘খবরদার, গিলে ফেলবেন না!’ সাবধান করল পাশা, ‘তাহলে কিন্তু মস্ত বিপদে পড়বেন। পেট কেটে বের করতে হবে।’
কমপক্ষে পাঁচ সেকেন্ড পাথুরে দৃষ্টিতে পাশার দিকে তাকিয়ে রইল রিনিতা। তারপর একদলা চুইংগাম মুখ থেকে বের করে পাশার ছড়ানো হাতের তালুতে ফেলে দিল।
দলাটার ভেতর থেকে বড় দুটো দামি হীরা বের করল পাশা।
ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে ওমর আলি। পাশা তার দিকে ফিরে বলল, ‘এগুলোই খুঁজছিলে, তাই না?’
একান-ওকান চওড়া হলো ওমর আলির হাসি। পরক্ষণে গম্ভীর হয়ে গেল। শীতল দৃষ্টিতে রিনিতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কত দিন থেকে করছ এ কাজ?’
বিড়বিড় করল রিনিতা, ‘বহুবার আপাকে নিষেধ করেছি, আপা করিস না করিস না, একদিন না একদিন ধরা পড়তেই হবে!’
‘এখন আর আপার দোষ দিয়ে লাভ নেই,’ ওমর আলির গলায় কঠিন স্বর।
‘টাকার লোভে করিনি আমরা, স্যার’, শুকনো কণ্ঠে বলল রিনিতা। ‘আমাদের একটা ছোট ভাই আছে, নাম রুনু। আমাদের বাবা-মা নেই। তারপরও তিন ভাইবোনে মিলে ভালোই ছিলাম। হঠাৎ পেটে ক্যানসার ধরা পড়ল রুনুর। অনেক খরচ। শুধু ক্লাবে নেচে কিংবা চাকরি করে সেই খরচ বহন করা সম্ভব ছিল না।’
‘তাই বলে স্মাগলিং!’ পাশার দিকে তাকাল ওমর আলি, ‘কী করে করত?’
‘এখনো বোঝোনি?’ পাশা বলল, ‘ঠিক আছে, বলছি। মুখে করে পাথর বহন করত জয়িতা। চুইংগামের সাহায্যে সেগুলো সাত নম্বর সিটের নিচে আটকে দিয়ে বেরিয়ে যেত। পরে, ইনসেক্টিসাইড স্প্রে করার ছুতোয় বিমানের ভেতরে গিয়ে সেগুলো বের করে নিত রিনিতা। মুখে করে আবার এয়ারপোর্টের বাইরে বের করে নিয়ে যেত। বাকিটা তুমিই বলো, রিনিতা।’
‘তারপর আপা কাস্টমসের বাইরে বেরিয়ে আমার কাছ থেকে হীরাগুলো নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিত আমির হোসেনের কাছে’, রিনিতা বলল, ‘রুনুর চিকিৎসার জন্য আলতাফের কাছে টাকা চেয়েছিল আপা। টাকা দিয়েছে, তবে আপার সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার বিনিময়ে। সেটার ছবি আবার ভিডিও করে রাখে, তারপর শুরু করে ব্ল্যাকমেল। বলে, ওর কথা না শুনলে ফেসবুকে সব ছবি ছড়িয়ে দেবে, ভাইরাল করে দেবে। শয়তানটার কথামতো কাজ না করে আর কোনো উপায় ছিল না আমাদের।’
ওমর আলির মন গলল না, ‘ধরা পড়লে সবাই এসব কথাই বলে। এখন আমার অফিসে চলো, আরও অনেক কথাই জানতে পারব!’ পাশার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পাশা, থ্যাংকস।’
‘ওকে, মোস্ট ওয়েলকাম!’ পাশা জবাব দিল।
রিনিতার দিকে তাকাল।
কাঁদছে না মেয়েটা।
পাথর হয়ে গেছে যেন।
পাশা বলল, ‘তুমি যাও ওর সাথে। আমি দেখব, তোমার ভাইয়ের কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না।’
প্রথমে ফোঁপাল মেয়েটা।
তারপর হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ল।
উৎস: প্রথম আলো শিল্প ও সাহিত্য, অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল।