গোয়েন্দার ন্যায় ছদ্মবেশে কাজ শেষে ফেরার সময় প্রায় প্রতিদিনই তার সাথে আমার দেখা হয়। একই ধরনের গণপরিবহনে যখন সাময়িক আস্তানায় ফিরি, তখন সে অফিসে যায়। সামঞ্জস্যপূর্ণ এই সময়ে প্রায়ই সে পরিবহনটিতে আমার সহযাত্রী হয়। মাঝে মাঝে মুখোমুখি বসে আর কখনো কখনো পাশাপাশি। আমার জন্য একটি জিপ বরাদ্দ থাকলেও বিশেষ কাজের গোপনীয়তা রক্ষার্থে সে সময় আমি পাবলিক যান ব্যবহার করি।
পেশাগত জীবনে আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার। প্রজাতন্ত্রে তখন সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলের সঙ্কটকাল চলমান। গুরুত্বপূর্ণ একটি দাফতরিক কাজে আমাকে হাতিয়ায় পাঠানো হয়। হাতিয়া একটি সুজলা, সুফলা দ্বীপ উপজেলা। যার সদর এখন ওছখালি নামক স্থানে এবং আয়তন বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলার চাইতে অনেক বেশি। ২১০০ বর্গকিলোমিটার অধ্যুষিত স্থানটির অবস্থান নোয়াখালী সদর থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে। আমি সাগরিয়া থেকে ওছখালি ফিরতে একদিন কৌতূহলবশত মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করি, ‘এক্সকিউজ মি, বিষয়টি যদি আপনি অন্যভাবে না নেন, তাহলে বলবেন কি, প্রতিদিন এ সময় আপনি কোথায় যান? ’
‘জি, আমি একটা বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করি।’
‘আপনি কোথায় লেখাপড়া করেছেন?’ তার মার্জিত সাজসজ্জা আমাকে এমন প্রশ্ন করতে প্রণোদিত করে।
‘আমি আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ, চট্টগ্রাম থেকে অ্যাকাউন্ট্যান্সিতে অনার্স-মাস্টার্স করেছি।’
বলার অবকাশ নেই, মেয়েটি একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যাংক অফিসার। চান্দের গাড়ি চলার সাথে সাথে প্রসঙ্গক্রমে আমাদের আলাপ অব্যাহত থাকে। মফস্বল এই শহরের একমাত্র যাত্রীবাহী যানের নাম চান্দের গাড়ি। এ ছাড়া বিকল্প কোনো গাড়ি নেই। যার সিট সংখ্যা তিন সারিতে একুশ এবং ড্রাইভিং সিটের পাশে দু’জন নিয়ে ২৩ জন। বাহ্যিক কাঠামো অনেকটা লং বডি ল্যান্ড রোভার জিপের মতো। বিভিন্ন স্থানে পূর্বে মুড়ির টিন হিসেবে যে যানটি খ্যাত ছিল। এটি দৃশ্যত ও লক্ষণীয়ভাবে সেরকমই।
সপ্তাহখানেক বাদে শিলাকে একটু ভিন্ন সাজে চোখে পড়ে। একহারা গড়নের মাঝারি মানের দ্বীপবাসী মেয়েটিকে একই অঙ্গে ভিন্নরূপি মনে হয়। ইতোপূর্বে তাকে শাড়িতে দেখা যায়নি। কিন্তু আজ ও পরে এসেছে আকাশি নীল জর্জেটের ওপর চুমকি বসানো শাড়ি। ম্যাচিং ব্লাউজের বাইরে তার উন্মুক্ত উজ্জ্বল বর্ণের হাত দুটি দেখে আমার প্রাচ্য রমণীদের কথা মনে পড়ে যায়। মাস দুয়েক আগে জাপানের ওসাকায় ইয়ানমার ডিজেল ইঞ্জিনের ওপর অপারেশন এবং মেইনটেন্যা›স কোর্স করতে গিয়েছিলাম। শিলার অগ্রবাহুর অনাবৃত অংশটুকু দেখে পথেঘাটে জাপানি ললনাদের অঙ্গসৌষ্ঠব চোখে পড়ার দৃশ্য ভেসে ওঠে। ক্রমেই তার আচরণ, অবয়ব, ব্যবহার আমাকে বিমোহিত করে তোলে। তার ভেতরও হয়তো কোনো প্রণয়াকাক্সক্ষা আমার মতো ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে সঞ্চারিত হতে থাকে।
শিলা এখন আর আড়ষ্টতায় দূরবর্তী নয়। চান্দের গাড়িতে পাশাপাশি আসনসহ উত্তরোত্তর নানাভাবে নিকটবর্তী। ও আমাকে তার সেলফোন নম্বর দিয়েছে। ক্ষুদে বার্তায় আগাম সময়কাল ঠিক করে আমরা প্রায়ই কথা বলি। দেশের কথা, সমাজের কথা, সভ্যতার কথা, মানুষের নানা আচরণের কথা। দ্বীপবাসী হাতিয়ার মানুষের জীবনযাপনের প্রক্রিয়া। তাকে কখনো বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘সময় ও পরিস্থিতি বলে দেবে। আমি যার সাথে আমার ইচ্ছেগুলো, ভাবনাগুলো শেয়ার করতে পারব, তার সাথেই বসবাসের কথা ভাবব।
অফিস এবং এলাকার দু’একজন খারাপ প্রকৃতির মানুষ তার প্রতি যে ইঙ্গিতময় দৃষ্টি দেয়, এ কথাটি সে আমাকে জানালে তা আমি কৌশলে এবং প্রচ্ছন্নভাবে দমন করতে সমর্থ হই। কারণ সেখানে আমার বিশেষ নিয়োগের বিষয়টি অধিকাংশ কর্তাব্যক্তিসহ অনেক রুই কাতলার জ্ঞাপনের ভেতরে ছিল। পরিণামে আমার অভিমতের ব্যাপারটি তখন জরুরিভাবে বিবেচিত হতো।
শিলা এখন আমার কাছে অনেক সাবলীল এবং সহজেই তাকে বুঝতে পারি। আমরা নিরিবিলিতে কথা বলার জন্য একদিন হাতিয়া সরকারি কলেজ মাঠে যাই। নিরুপদ্রব মনে না হওয়ায় সেখান থেকে আমরা আরো এক কিলোমিটার দূরে জাহাজমারা পর্যন্ত গিয়ে চান্দের গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। হাঁটতে থাকি গন্তব্যহীন পথে। পরিচয়ের চার সপ্তাহ পর এই প্রথম পাশাপাশি দু’জন নিরিবিলি আর কিছুটা নির্জনে হাঁটতে থাকি অজানার উদ্দেশে। সে সময় রাস্তার পাশের গাছগুলো যেন প্রতিবি¤¦ তৈরি করে আমাদের ছায়াবৃত করে রাখে। রাজপথ থেকে একটু নিচে ফসলি জমি। সেখানে সোনালি ধানে ভরে গেছে মাঠ। বিকশিত ধানের মৌ মৌ ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে এক ধরনের মাদকতার সৃষ্টি করে। আমাদের চলার পথ হয়ে ওঠে স্বপ্নীল অনুভূতির এক বিচরণ ক্ষেত্র। দু’জন সংযুক্তির ন্যায় অনুবন্ধীরূপে অতি মন্থরগতিতে সামনে অগ্রসর হতে থাকি। অনন্তর মনে পড়ে যায়, রবিঠাকুরের শেষের কবিতা উপন্যাসের লাবণ্যর উদ্দেশে অমিতের একনিষ্ঠ ও সুসঙ্গত উচ্চারণ- আমারও পাগলামি প্রকৃতিতে ভর করে, ভাবাবেগে স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করতে থাকি :
‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি
আমরা দু’জন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল...।’
তারপর...। সপ্তাহখানেক যাবত শিলার কোনো খবর নেই। সেলফোন বন্ধ। ক্ষুদে বার্তা জবাবহীন। আমি তার বাড়ির ঠিকানা জানি না। ব্যাংকে গিয়ে ঠিকানা সংগ্রহ করতেও আত্মসম্মানে বাঁধে। অপেক্ষার যন্ত্রণা শেষ করে সাগরিয়া থেকে প্রতিদিন আমি একাই সেই প্রাগৈতিহাসিক যানে আবাসনমুখী হই। চান্দের গাড়ির শব্দ আমার শ্রবণেন্দ্রিয়কে নাকাল করে তোলে। সবকিছুতে বিরক্তি ছাড়া পাশে বসা সহযাত্রীদের কোনো কথাই আমার কানে ঢোকে না। শিলার অনুপস্থিতি আমার অজান্তে ভেতরে ভেতেরে ভাঙচুর শুরু করে। নিমিত্ত শিলার কোনো হদিস নেই।
আজ রোববার। নিত্যদিনের মতো ফিরতি পথে মনে মনে আশা নিয়ে আমি শিলার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। হয়তো আমার আশার আহবানে সাড়া দিয়েই সেদিন কাকতালীয়ভাবে শিলা সত্যি সত্যি গাড়িতে ওঠার জন্য আসে। আমরা একত্রে গাড়িতে উঠে পড়ি। শিলার মনটা খুব খারাপ। ও কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। ‘আসলে আমার করার কিছু ছিল না। যে ভাইয়া ঢাকায় থাকে, সেই ঠিক করেছে। ছেলেটা ঢাকায় ভালো চাকরি করে। পোশাক কারখানায় হিউম্যান রিসোর্চ অফিসার। বাড়ি এখানেই তমরুদ্দি বাজারের দিকে। এটা আমি চাইনি। আমাকে ভুল বুঝবেন না।’
ওর কথায় আমার বুকের গহিন হিম হয়ে যায়। মনে হয়, যত্ন করে, নিরাপত্তা দিয়ে, পাহারা দিয়ে প্রতিপালন করা সম্পদ কে যেন চুপিসারে অপহরণ করে নিয়ে যেতে চাইছে। সে এক দুঃসহ মর্মবেদনার ব্যাপার।
অশ্রুসজল চোখে সে বলতেই থাকে, ‘আমি একজন অপয়া, আমি ভীত। আমি মুখ ফুটে আপনার প্রতি আমার দুর্বলতার কথা কাউকে বলতে পারিনি। অভিভাবকদেরকেও বোঝাতে পারিনি।’
কথা বলতে বলতে পরিবহনটি প্রায় আমার অস্থায়ী আবাসনের কাছে চলে আসে। ডাকবাংলো বরাবর পৌঁছার আগে তার অদূরেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। আমাকে অশ্র“সিক্ত বিদায় সম্বর্ধনা জানাতে শিলা তার হাত দুটি বাড়িয়ে চলৎশক্তিহীনভাবে নাড়াতে থাকে। আর চান্দের গাড়ি ছুটে চলে তার গন্তব্যের দিকে।