ইমনের বোনের বিয়েতে বেড়াতে এলাম কুমিল্লার ঈশ্বরপুর। গ্রামটির পাশঘেঁষে তরতর করে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে স্রোতস্বিনী তিতাস। নদীর ওপারে বিস্তৃত ফসলের মাঠ। বর্ষায় সুদূর থেকে তেড়ে আসা ঢেউগুলো গ্রামে এসে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে যায় চিরতরে। জলসিক্ত ফিনফিনে বাতাস নিত্য এসে ওমর আলীর বাড়ি, গাছগাছালি ও আবাসস্থলের ঘাম জুড়িয়ে দেয়।
সারা দিন বেশ ভালোভাবেই কেটে গেল; অতিথি আগমন, ভোজন-সম্ভাষণ ও আদর-আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে। কিন্তু রাতে ঘুমোতে গিয়ে পড়লাম বিষম বিভ্রাটে। শোবার জায়গা নেই, বাড়ির বিছানা ও ফ্লোরগুলো দূরাগত অতিথিদের দখলে। নিরুপায় হয়ে চেয়ারে চেপে বসে রইলাম বাড়ির শেষ প্রান্তে। তিতাসের ঢেউয়ের ওপর নবমীর চন্দ্রালোকের কী পরম প্রেমময় মিতালি! ফিনফিনে বাতাস বইছে মায়ার পরশ জাগিয়ে।
আমাকে একেলা বসে বসে ঝিমাতে দেখে ইমন এসে বলল, ‘মুসাফির, কোথাও শোবার জায়গা নেই, না-ঘুমিয়ে রাত কাটাব কী করে! চলো, আমাদের পুরনো ঘরটিতে শোবার ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখি! ওই ঘরে ভুল করেও কেউ প্রবেশ করতে চায় না। পাটি পেতে অন্তত গা হেলানো যায় কি না দেখা যাক...
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মুসাফির বলে, ‘চলো, তাড়াতাড়ি চলো; খুব ক্লান্তি বোধ করছি।’
ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে লাইট অন করে ইমন। ভাঙাচোরা জীর্ণ ঘরটির ভেতরে শতাব্দীর জমে থাকা ময়লা-আবর্জনার স্তূপ কিলবিল করছে, বিশ্রি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ঘরের ভেতরে। আর বিচিত্র পোকা-মাকড় নিশ্চিন্তে আস্তানা গেড়ে দখল করে আছে গোটা ঘরটিকে। ঘরের ভেতরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে- বিগত কয়েক দশক ধরে বাড়ির যত অকেজো ভাঙাচোরা ও অব্যবহৃত মালামাল এই ঘরে সঞ্চিত হয়ে আছে।
কোনোমতে একটি পাটি বিছিয়ে হাতকে উপধান বানিয়ে গা হেলিয়ে শোয়ার পর মুসাফিরের দৃষ্টি নিপতিত হচ্ছে- চার পাশে যত্রতত্রভাবে অগোছালো পুরনো জিনিস পত্রের দিকে।
দু’জনকে পেয়ে ঘরের মশারা যেন মচ্ছব পেয়ে বসেছে। ঘিরে ধরেছে রক্ত চুষে নেয়ার নেশায়। মশারা গায়ে চেটে বসলেই থাপ্পড় বসিয়ে দেয় ঠাস ঠাস শব্দে। মশার অবাধ্য অত্যাচারে টিকতে না পেরে বিরক্তমনে মুসাফির উঠে বসে পড়ে।
আচমকা মুসাফিরের চোখ নিবদ্ধ হয়- ঘরের কোনে রশিতে আটকানো একটি পুরনো ভাঙাচোরা একতারার দিকে।
শোয়া থেকে উঠে মুসাফিরকে একতারাটির কাছে যেতে দেখে ইমন বলে, ‘কোথায় যাচ্ছিস মুসাফির?’
উত্তর না দিয়ে রশি থেকে একতারাটি খুলে হাতে নিয়ে, পুনরায় বিছানায় এসে বসে মুসাফির বলে, ‘এটি আবার কী রে?’
শোয়া থেকে উঠে বসে মুচকি হেসে ইমন বলে, ‘এটি আমার দাদুর একতারা। তিনি স্বহস্তে এটি বানিয়েছিলেন, লাউয়ের খোল দিয়ে।’
অট্টহাসি হেসে মুসাফির বলে, ‘তোর দাদু কি গায়েন ছিলেন নাকি?’
মুসাফিরের হাত থেকে একতারাটি নিয়ে ইমন বলে, ‘দাদুর কণ্ঠের গান শুনলে, তোর মন আর ঘরে বসবে না, বিবাগী হয়ে পালিয়ে যেতে চাইবে কোন অচেনা রহস্যালোকে!’
আচমকা আবছায়া বিষাদের রেখা ফুটে ওঠে ইমনের চেহারায়! নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল- একতারাটির দিকে!
কতকাল আগের একতারাটি কত ঘটনার সাক্ষী ও যুগের সঞ্চিত সুর বুকে নিয়ে পড়ে আছে। সুরের তৃষ্ণায় ঘুণ ধরে ফেলেছে বাঁশের কঞ্চিতে! আর ময়লা ও ধুলোবালি জমে মরিচা ধরেছে একতারার তারে, যে তারের কিনকিন মায়ামন্ত্র সুরের মাঝে বিলীন হয়ে যেত মনের কামনা-বাসনা!
কত শত মানুষকে বিবাগী করেছে এই একতারা, কত মানুষকে দিয়েছে মুক্তির অমৃত সুরব্যঞ্জনা; কত মানুষের মনের তৃষ্ণা মিটিয়েছে, কত মানুষকে করেছে বিবাগী, কত মানুষকে টেনে নিয়ে গেছে সুরধনি তীরে!
মুসাফিরের দাদা ওমর আলীর জীবন গত হয়ে গেছে এক যুগ আগে। কবর খুঁড়ে তার অস্থি-মাংসের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া না গেলেও, ঘুণপোকা ও মরিচার বিরুদ্ধে লড়াই করে আজো বেঁচে আছে তার একতারাটি।
এই একতারা ওমর আলীকে যেমন দিয়েছিল আত্মসুখ, সীমাহারা আনন্দ তেমনি পাশাপাশি দিয়েছিল জাগতিক যন্ত্রণা, বিরহের গন্ধমাখা পারিবারিক অশান্তি ও সাংসারিক দৈন্যদশা।
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান বলে ওমর আলীর পড়ালেখার দৌড় বেশি দূর গড়ায়নি; মাধ্যমিক পর্যায়ের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। স্কুল ছেড়ে বৃদ্ধ বাবার সহযোগী হিসেবে কর্মে নিয়োজিত হয় ক্ষেত-খামারে...
বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে যাওয়া, বাবাকে সাময়িক বিশ্রামে দিয়ে নিজে গিয়ে লাঙ্গলের হাল ধরে জমি চাষ করা, নিড়ানি দিয়ে ফসলি জমির আগাছা পরিষ্কার করা ইত্যাদি।
একদিন দুপুরে খাবার নিয়ে বাবাকে খেতে দিয়ে নিজে গিয়ে লাঙ্গলের হাল চেপে ধরে ওমর আলী। এক হাতে লাঙ্গলের হাল, অন্য হাতে পাজন দিয়ে খেদিয়ে গরুগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে চাষ করছে, অন্য দিকে কণ্ঠে ধরেছে মরমি গান...
‘নিদয়ার পিরীতে পইড়া সার হইলো কান্দন
এত ভালোবাইস্যাও তারে হইলো না আপন’
পাশের জমির আইল দিয়ে অনন্তপুর মুনসুর বয়াতি হেঁটে যাওয়ার সময় তার গান শুনে থমকে দাঁড়ান। জমির আইলে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনে রইল ওমর আলীর গাওয়া গান।
তাকে এভাবে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, মুনসরকে ডেকে ওমর আলীর বাবা আব্বাস উদ্দিন বললেন, ‘কী বয়াতি, এমন কইরা কী দেখতাছো?’
আব্বাস উদ্দিনের কাছে এসে দাঁড়িয়ে মনসুর বয়াতি বললেন, ‘কোনো কিছু দেহি না, হুনতাছি।’
মুখের খাবার গদগদ রবে গিলে আব্বাস বলে, ‘কী হুনতাছো?’
ঈষৎ হাসির আভা ছড়িয়ে মনসুর বয়াতি বললেন, ‘দেহো না, তোমার পোলার কী মধুর মায়াবি গলা! তার গান হুইন্যা পরান ভইর্যা যায়, আব্বাস উদ্দিন।’
হাঁ করে জগের পানি গলায় ঢেলে দিয়ে মুচকি হেসে ওঠে আব্বাস। তারপর বিড়িতে আগুন ধরিয়ে দুটো টান দিয়ে ধুঁয়া ছেড়ে আব্বাস বলে, ‘দেখতে হইব না কার পোলা...’
যাওয়ার সময় মনসুর বয়াতি বলে গেলেন, ‘তোমার পোলা একদিন বড় গায়েন হইব, আমি কইয়্যা গেলাম। নাম কী তোমার পোলার?’
‘ওমর আলী’।
‘সুন্দর নাম রাখছো। ওমর আলীকে, আমার আস্তানায় পাঠাইও আব্বাস।’
অনন্তপুর গ্রামের পূর্ব পাড়ায় মনসুর বয়াতির বাড়ি; তিনি একজন উদাসী মরমি বাউল। সংসারে যবনিকা টেনে নির্জন পুকুরপাড়ে আস্তানা গেড়ে যোগসাধনা করেন মনসুর বয়াতি।
উদাসী বাউলদের মিলনক্ষেত্র তার আস্তানা; নিয়মিত যাতায়াত করেন বহু মুনি-ঋষী। ওমর আলী নিয়মিত নদী সাঁতরে মনসুর বয়াতির আস্তানায় গিয়ে পড়ে থাকে; একতারার সুরে সুরে গানের রেওয়াজ শেখে বয়াতির কাছে।
মনসুর বয়াতি সংসার থেকে বিদায় নেয়ার আগে একতারার সুরের শেকলে বেঁধে দিয়ে গেলেন ওমর আলীকে। পরপারে যাওয়ার আগে ওমর আলীকে ডেকে কাছে বসিয়ে নিজের সাধের একতারাটি ওমর আলীর হাতে তুলে দিয়ে মনসুর বয়াতি বললেন, ‘ওমর আলী, তোকে ঔরসজাত সন্তানের চেয়েও বেশি মহব্বত করে গান শিখাইছি, একতারার তাল শিখাইছি; যাওয়ার আগে আমার সাধের একতারাটি তোর কাছেই রাইখ্যা গেলাম, তুই এর অযত্ন করিস না।’
বয়াতির আত্মার ধন একতারাটি বুকে চেপে ধরে রাখে ওমর আলী।
বাবার মৃত্যুর পর সংসারের প্রয়োজনে তাকে বিয়ে করতে হলো। ঘাড়মোরা গ্রামের অল্প শিক্ষিতা গৃহস্থী ঘরের সূর্যবানু নামে এক ষোড়ষী কন্যাকে বউ করে ঘরে আনে ওমর আলী।
বছর দুয়েক বেশ ভালোই কেটেছে সংসারজীবন! ঝামেলা শুরু হলো তখনই- যখন ওমর আলীর প্রথম সন্তান স্ত্রীর পেটে গিয়ে জাগয়া করে বসে। স্ত্রীকে ঘরে একলা রেখে ওমর আলী একতারা নিয়ে বের হয়ে যায়; সারা রাত কোথায় কাটিয়ে ভোরে ঘরে আসে। এ নিয়ে বহুবার বাক-বচসা হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। কিন্তু না বন্ধ হলো তার গান গাওয়া, না বন্ধ হলো একতারার গুনগুনানি।
এ অবস্থা যখন চরমে গিয়ে পৌঁছে, তখন ছয় মাসের সন্তানকে পেটে নিয়েই একবুক অভিমানে সূর্যবানু বাপের বাড়িতে চলে যায়। ওমর আলী বেশ কয়েকবার গিয়েও তাকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। স্ত্রীর শূন্যতা ওমর আলীর মনে যেন আরেক বিচ্ছেদের সুর জাগিয়ে তুলল!
স্ত্রী চলে যাওয়ার পর তার একতারার তার যেন আরো শাণিত হয়ে ওঠে; বেজে ওঠা সুর-রাগিণী যেন মানুষের গহনচিত্তে গিয়ে নাড়া দেয়! এলাকার সকল বৈঠকি গান ওমর আলীকে ছাড়া জমেই ওঠে না। প্রায় প্রতি রাতে কোথাও-না-কোথাও তার বায়না থাকেই।
বছর দুয়েক পার হয়ে গেল; স্ত্রীর শূন্যতা বিবাগী করে তুলল ওমর আলীকে। শ্বশুর বাড়িতে তার প্রথম সন্তান মোতালেবের জন্ম হয়, অথচ পুত্রকে দেখার সৌভাগ্য হয় না তার। গভীর রাতে নিজ পুত্রকে দেখার জন্য তার হৃদয়ের গভীর প্রকোষ্ঠে শূন্যতার হাহাকার ঢেউ জেগে ওঠে; গোপনে নীরবে কেঁদে মরে! মনের জ্বালা খুব বেশি পীড়ন করে উঠলেই হাতে তুলে নেয় একতারা; একতারার সুর আর চোখের জলে বুক ভাসিয়ে গেয়ে বেড়ায় বিচ্ছেদ রাগিণী...
সেবার শ্রীপুর ফকির বাড়ির বার্ষিক ওরস। আগেই বায়না করে রেখেছে ওমর আলীকে, ওখানে সারা রাত গান গাইতে হবে। শ্রীপুরের পাশের গ্রামটিই ঘাড়মোরা। একটি পাকা রাস্তা গ্রাম দু’টিকে বিভক্ত করে রেখেছে। তবে ফকির বাড়িটি শ্রীপুরের শেষ প্রান্তে, রাস্তার ওপারেই ঘাড়মোড়ার প্রথম বাড়িটি ওমর আলীর শ্বশুরবাড়ি।
রাত দশটার পর শুরু হলো সামা-সঙ্গীত। মাইকে ওমর আলীর নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের উৎসাহ বেড়ে উঠেছে, শুরু হয়ে গেছে মাতামাতি...
একতারায় বিচ্ছেদের রাগ বাজিয়ে শুরু করছে গান-
‘ও মোর নিঠুর বন্ধুরে...
আর কত দিন রাখবি আমায় দূরে’...
এমনি দর্শক সারি থেকে উৎফুল্ল ধ্বনি ভেসে এলো- হ্যাঁ.. হ্যাঁ.. এটাই, এটাই চাই...
সুরের কী সীমাহারা রহস্যময়তা! সেই বিচ্ছেদের সুর শ্রীপুরের সীমানা ডিঙিয়ে পৌঁছে গেলো সূর্যবানুর মনের নিগূঢ়ে! শোয়া থেকে উঠে বসে কান পেতে দিলো- অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বেজে ওঠা ওমর আলীর গানের প্রতি...
একসময় সূর্যবানুর মনকে আর ঘরে বেঁধে রাখতে পারেনি, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। স্বামীহারা শূন্যতার বানে সে ছুট লাগায় ফকির বাড়ির দিকে...
নারী-দর্শকদের ভিড়ে গিয়ে মুখ লুকিয়ে বসে পড়ে সূর্যবানু। স্বামীর কণ্ঠভেদি গানের সুরে সুরে কাঁদছে অবিরত...
স্বামীর প্রতি তার এত দিনকার পাষানবৎ অভিমান যেন একতারার ওই কিনকিন সুরের পরশে বিলীন হয়ে যাচ্ছে একে একে...
তখন শেষ বসন্তের পাতাঝরা এক সাঁঝের বেলা, এক হাতে একটি কাপড়ের ব্যাগ, অন্য হাতে তিন বছরের মোতালেবকে কোলে জড়িয়ে ধরে মাথা নিচু করে ধীরপদে স্বামীর বাড়িতে প্রবেশ করে সূর্যবানু। ওমর আলী তখন বাড়ির শেষ প্রান্তে বসে শুকনো তিতাসের দিকে তাকিয়ে আছে।
স্বামীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে লজ্জাস্নাত চাহনিতে তাকিয়ে থাকে সূর্যবানু! সাময়িক দাঁড়িয়ে থাকার পর মোতালেবকে স্বামীর সামনে রেখে পায়ে ধরে সূর্যবানু বলে, ‘আমারে মাফ কইরা দেও, তোমার ওপর যে জুলুম করেছি, তুমি মাফ না করলে, খোদায়ও আমারে মাফ করব না। সারা জীবন তুমি একতারা বাজাইয়া গান গাইবা, তোমার কাছে বইস্যা আমি হুনমু..
দু’চোখ ছাপিয়ে অশ্রু ঝরছে ওমর আলীর গাল ভাসিয়ে! কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ডুকরে কাঁদতে থাকেন ওমর আলী...
ওমর আলীর দেহে বার্ধক্যের ভাঁজ পড়ে গেলেও, একতারার সুর কিংবা গানে এতটুকুও ছন্দপতন হয়নি। আগের মতো বিভিন্ন মজলিশে গিয়ে গান গাইতে না পারলেও স্ত্রীকে সামনে বাসিয়ে গান গেয়ে যায় বিবাগী মনে...