পদ্মার সাথে সারাক্ষণ কী কথা বলে জমিলা তা কেউ জানে না। পদ্মার কাছে তার কী অভিযোগ তা নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায় না। সারাটা দিন তার পদ্মার তীরে বসেই কেটে যায়।
সকাল থেকে সারা দিন এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে বেলা শেষে বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি হাঁড়িতে চাল ধুয়ে চুলায়
বসিয়ে দেয় জরিনা। ছোট বোন শিরিনকে চুলার পাশে বসিয়ে জরিনা বলে- খুব সাবধানে আস্তে আস্তে লাকড়ি চুলায় দিবি। খেয়াল রাখবি জেন আগুন চুলার বাইরে না আসে। মা তো সারা দিন না খাইয়া নদির ধারে পইরা আছে। আমি যাই, মারে লইয়া আসি।
বসিয়ে দেয় জরিনা। ছোট বোন শিরিনকে চুলার পাশে বসিয়ে জরিনা বলে- খুব সাবধানে আস্তে আস্তে লাকড়ি চুলায় দিবি। খেয়াল রাখবি জেন আগুন চুলার বাইরে না আসে। মা তো সারা দিন না খাইয়া নদির ধারে পইরা আছে। আমি যাই, মারে লইয়া আসি।
দ্রুত নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছে জরিনা। মা মা বলে ডাকাডাকি করে। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয় পেয়ে যায়। মাও কি তাহলে বাবার মতো পানিতে ডুবে মরল। না না তা হতে পারে না। জোর আওয়াজে ডাকে সে- মা, অ মা মাগো কোথায় গেলে মা?
কোনো সাড়া নেই। নদীর ধারে ছোট ছোট দূর্বাঘাসের ফাঁকে ফাঁকে নাম না জানা ঘাসফুল।
এখনো দু’টি ছাগল ঘাস খাচ্ছে। নদীর টলমলে পানিতে এক ঝাঁক ডানকিনে মাছের পোনা ভেসে উঠে আবার তলিয়ে গেল। জরিনার চঞ্চল মন শুধু মাকেই খুঁজছে। নদীর পারে এক পাশে ছোট একটি বাঁশঝাড়। সে দিকে তাকাতেই জরিনা মানুষের পায়ের মতো কিছু দেখতে পায়। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যায় সে। ভালো করে কাছে গিয়ে দেখে ওর মা ওখানেই গভীর ঘুমে আছন্ন। জরিনা মায়ের মাথায় হাত দেয়। গায়ে হাত দেয়। জমিলা দুই চোখ মেলে শান্ত কণ্ঠে বলে- তুমি আইছ? আমি সারাটা দিন বইসা আছি, তুমি এতক্ষণে আইলা?
জরিনা বিরক্ত হয়ে বলে- এই মা তোমার ঘুম ভাঙে নাই? এই যে দেখ- আমি। আমি তোমার মাইয়া। ক্যান যে পাগলামি করো? জান না বাবা মইরা গেছে। নদীর ধারে বইসা থাকলে সে ফিরে আইব? চল বাড়িতে যাব। চার দিকে আন্ধার ঘনায়। তারা করে। বাড়িত চল মা।
জমিলা উঠে দাঁড়ায়। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে- হ্যাঁ বাড়িত যামো কিন্তু তুই আর কইতে পারবি না যে, তোর বাবা মইরা গেছে। তোর বাবা বাইচা আছে। আমি তো তার সাথে ঝগড়া করতাম, তাই সে গোস্যা করল এহনো ফিরা আইল না।
কথাগুলো বলতে বলতে কাঁদতে শুরু করল। জরিনা মাকে হাত ধরে টেনে বাড়িতে নিয়ে যায়।
শিরিন ছোট হলেও সংসারের ছোটখাটো অনেক কাজ করতে শিখেছে। মাকে নিয়ে ফিরতে জরিনার দেরি হয়ে গেল। ততক্ষণে ভাতের চাল ফুটে উঠেছে। দেরি হলে ভাত নরম হবে ভেবে শিরিন ভাতের মার ফেলে সিদ্ধ আলো আর বেগুনের ভর্তা বানিয়েছে। জরিনা বোনের কাজে খুশি হয়ে বলে, আমার সোনা বইন, খুব ভালো করসছ রে বইন। মার ফেলতে গিয়া হাত পুরস নাই তো।
শিরিন হাসি মুখে বলে- নারে বুবু কিছু অয় নাই। মারে লইয়া ডুব দিয়ে আয়। নদীর ধারে গিয়াও ডুব না দিয়া চইলা আইলা যে।
সাঝের বেলা আমি নদীতে ডুব দিতে পারি না বোন। বাবার কথা মনে অয়। বুক খান কাইপা ওঠে। তুই ভাত বার। আমি মারে লইয়া ছোট চাচার পুকুরে ডুব দিয়া অহনই আইতাছি।
পুকুর থেকে মাকে নিয়ে জরিনা বাড়ি ফেরে। অন্ধকার রাত। পাশের বাড়ি থেকে লোকজনের কথার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। নদীর ধারে হতদরিদ্র মানুষগুলো সন্ধ্যা হতে না হতেই রাতের খাওয়া শেষ করে। কেউ খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। কেউ কেউ খাওয়ার পরে খানিকটা সময় বসে গল্প করে পান-সিগারেট খায়। তারপর ঘুমিয়ে যায়।
ভিজা কাপড় ছেড়ে শুকনো একটি কাপড় গায়ে জড়ায় জরিনা। গামছার একটি ছেঁড়া টুকরা দিয়ে লম্বা চুলগুলো ভালো করে মুছে নেয়। গামছার টুকরাটা মুড়িয়ে চুলগুলো ঝেড়ে নেয় জরিনা। বেশ আরাম বোধ করে। মাকে নিয়ে খেতে বসে। খেতে খেতে বলেÑ শিরিন তুই তো খুব মজা কইরা ভর্তা বানাইতে পারস।
শিরিন মিটিমিটি হাসে। দুই বোন তৃপ্তির সাথে পেট ভরে ভাত খায়। হঠাৎ মায়ের দিকে চোখ পড়ে জরিনার। মা খুব আস্তে ভাত মুখে দিচ্ছে। কী যেন ভাবছে। গায়ের শাড়িটা বিভিন্ন জায়গায় ছেঁড়া। শরীরটাও ভেঙে গেছে। মাকে দেখে জরিনার বুকের ভেতরটা কেমন যেন হয়ে যায়। দুই চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। কষ্ট পাওয়া ছাড়া তার যে আর কিছু করার নেই। বোনটা খুব ছোট। তবু মানুষের বাড়িতে ঘরদোর ঝেড়ে বাসন মেজে অল্প কিছু টাকা পায়। ছোট বলে ন্যায্য টাকাটা দিতে চায় না কেউ।
দুই বোন লোকের বাড়িতে কাজ করে যা পায় তা দিয়ে তিনজনের খাওয়া-দাওয়া তেল-সাবান পরনের কাপড় সব হয়ে ওঠে না। মায়ের জন্য একটা শাড়ি কেনা জরুরি। কিন্তু জরিনার হাতে টাকা নেই। মাসের ১৫ দিন শেষ হয়েছে। হাতে যে ক’টা টাকা আছে তা দিয়ে বাকি ১৫ দিন এক বেলা খেয়ে কাটাতে হবে। মাসের প্রথমেই মাকে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে অর্ধেকটা টাকাই খরচ হয়ে গেছে।
ভাবতে ভাবতে জরিনা অস্থির হয়ে ওঠে। এমন সময় শিরিন বলে- বুবুরে এবার ঈদে একটা নতুন জামা কিনে দিবি? ঈদের তো অহনো দুই মাস বাকি আছে। দিবি বুবু?
জরিনা কোনো কথা বলে না। মায়ের খাওয়া শেষ হলে থালা-বাটি গুছিয়ে রাখে। মাকে শুইয়ে দেয়। শিরিন চুপচাপ শুয়ে পড়ে। জরিনা এগিয়ে যায় ছোট বোনটির কাছে। বলে- শিরিন, আমার লক্ষ্মী সোনা, আমারও খুব ইচ্ছা করেরে তোর জন্য একখান নতুন জামা কিনি। চুল বাঁধার ফিতা, একখান আলতা আর কত কী। তুই নতুন জামাখান পইরা সাইজা ঈদের সারাটা দিন আমার চোখের সামনে দিয়া ঘুইরা বেড়াস। শিরিন, অ শিরিন ঘুমাইয়া গেছস বোন।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে জরিনা। মায়ের মাথায় হাত রাখে সে। বুঝতে পারে মা এখনো ঘুমায়নি। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। মাথায় হাত দিতে দিতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় জরিনা। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে একটি দিনের দৃশ্য। একটি ছোট্ট ইতিহাস।
সারাজীবনই জরিনাদের অভাবের সংসার। তার বাবা জমির আলী ছিলেন খুব সাদাসিদে এবং অলস প্রকৃতির মানুষ। কাজ করতে চাইতেন না। জমিলা এ বাড়ি ও বাাড়ি ঘুরে তার জন্য কাজ ঠিক করতেন। তিনি দুই দিন কাজ করেই আর যেতে চাইতেন না। এভাবে তিনি অনেক কাজই ধরেছেন আর ছেড়েছেন। কোনো কাজ মন দিয়ে কোনো দিন করতে চাননি। এদিকে ছোট দুটো শিশু নিয়ে মর্মান্তিক কষ্ট করেছে। নিজে মানুষের বাড়িতে কাজ করেছেন। সংসারের প্রতি বউ-সন্তানের প্রতি কোনো দায়িত্ব বোধ ছিল না জমির আলীর। তাই মাঝে মধ্যেই স্বামীর সাথে ঝগড়া করতেন জমিলা।
একদিন দুপুর বেলা জমির আলী বাইরে কোথা থেকে ঘুরে এসে জমিলাকে বলে - বউরে, বর খুদা পাইছে। ভাত রান্ধস নাই? কয়ডা ভাত দেস না বউ।
উদাসীন স্বামীর কথা শুনে জমিলা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। বলে, দুই দিন ধইরা ঘরে একটা চাইলও নাই। মাইয়া দুইডা না খাইয়া আছে। তুমি কি তার খবর রাখছ? তুমি কেমন বাপ? কামাই করবার পার না খালি খাইবার পার। নদীতে ডুইবা মরতে পার না।
জমির আলী কোনো কথা না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। তারপর সন্ধ্যা হয় জমির আলী ফিরে আসে না। জমিলা ভাবে, আশেপাশেই কোথাও আছেন। ঘরে এলেই সে চাল ডাল আনতে বলবে, ঝগড়া করবে। সে ভয়েই জমির আলী আসছে না। জমিলা শিশুদের নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর রাতে সে একটি দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ওঠে। ঘুম ভেঙে ওঠে অস্থির হয়ে ঘরের দরজা খুলে বাইরে যায়। বাড়ির সব জায়গায় সে স্বামীকে খোঁজে। গলা ছেড়ে ডাকে- জরিনার বাপ, অ জরিনার বাপ। তুমি কোথায় আছো? কতা কও। আমার বড় ডর লাগতাছে। অ জরিনার বাপ তুমি কোথায় গেলা।
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে জমিলার মন আনচান করে ওঠে। সে পাশের বাড়ির গফুর আলীকে ডাকে- অ ছোট মিয়া উঠ তো ভাই। তোমার মিঞা ভাইরে তো খুঁইজা পাইতাছি না। অ ছোট মিঞা উঠ না ভাই। আমি বড় বিপদে পড়ছি।
ঘর থেকে বের হয়ে এলো গফুর আলী আর আমিনা বেগম। তারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল- কী অইছে ভাবী অহনো তো সকাল অয় নাই। ডাকতাছ ক্যান?
জমিলা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে- তোমার ভাইরে খুঁইজা পাই না। কাইল দুপুর থিকা হ্যায় বাড়িত নাই। আমি নদীর ধারে যাইবার চাই।
কী কও ভাবি এ তো চিন্তারই কথা। চল আমরা নদীর ধারে গিয়া দেখি।
ততক্ষণে চার দিক ফর্সা হয়েছে। নদীর ধারে একটু খোঁজাখুঁজির পরই জমিলার চোখে পড়ে তার স্বামী নদীর পানিতে ভেসেই এক পাশে ভিড়ে আছে। জমিলা চিৎকার করে বলল- অ ছোট মিয়া ওই যে দেখ জরিনার বাপ পানিতে ভাসতাসে।
গফুর আলী এগিয়ে গিয়ে দেখল সত্যিই জমির আলী পানিতে ভাসছে। তার দেহটা ফুলে বড় হয়ে গেছে। গফুর আলী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে- আহারে ভাই তুমি কী করলা ভাই। আমিনারে, আমার ভাই মইরা গেল। আমি একা হইয়া গেলামরে আমিনা।
জমিলা নির্বাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মুখে কোনো ভাষা নেই। চোখে পানি নেই। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। জমির আলীর দাফন হলো। গ্রামের লোকজন জানাজার নামাজ পড়ল। কবর খুঁড়ে কবর দেয়া হলো। জরিনা আর শিরিন কত কান্নাকাটি করল; কিন্তু জমিলার চোখে কোনো পানি নেই। সেই দিন থেকেই তার কথা চলাফেরা সব কিছুই অস্বাভাবিক হয়ে গেল।
ভাবতে ভাবতে দুই চোখ ভরে ওঠে জরিনার। রাত অনেক হলো। ঘুমিয়ে পড়া উচিত। সকালে আবার কাজে যেতে হবে। খেজুর পাতার মাদুরটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ে জরিনা। বুক ফেঁটে বেরিয়ে আসে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস।