হট্টগোল ঠেলে বের হলাম। রাইহানকে আগেই ফোন দিয়ে গেটে দাঁড়াতে বলেছিলাম।
রাইহান আমার ড্রাইভার। কাজেই অযথা দেরি করা অনুচিৎ মনে হলো। তাছাড়া হাসপাতাল পাড়ায় এমন হট্টগোল এখন প্রতিবেলার ব্যাপার। ডাক্তার আর রোগী এখন যেন চিরশত্রু! একটা সময় ছিলো, যখন জটলা দেখলেই এগিuয়ে যেতাম। কখনো থাকতো আগ্রহ আবার কখন কৌতূহল। জটলাটা উপভোগ করতাম আমরা। ঢাকার মানুষেরা যেমন গো গ্রামের পুকুর উপভোগ করে এমনই উপভোগ। কথাটা ধ্রুব বলতো। ও ঢাকাইয়া।
ও হ্যাঁ , আমার পরিচয়টাই তো দেওয়া হলো না। আমি শুভ। এখানকারই রেজিস্ট্রার। অনিক আমার মেডিকেল লাইফের বন্ধু। গাড়ি ছুটে চলছে চেম্বারে দিকে। রাইহান বললো, স্যার, দুই বন্ধু মারামারি কইরা আইছে। তাদের দুই পক্ষেরই হট্টগোল। দুইজনই ইলেকশনে যাবে। বন্ধু! কথাটা শুনেই যেন কেমন একটা লাগলো।
শীতের দিনে বৃষ্টি গুলো এমনই। মনে করিয়ে দেয় সেই পুরানো স্মৃতিকথা। মেডিকেল প্রফেশনে থেকেও মেডিকেল লাইফের বন্ধুদের সাথে দেখা হয়না কতদিন। এই কয় বছরে প্রত্যেকের সাথে ২-৪ বার দেখা হলেও এক সাথে বসা হয়না ১১ বছর। রি ইউনিয়নের প্লান হয়েছিলো কইবার কিন্তু শেষ নামেনাই। আজ কেন যেন ১৪ বছর আগে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। হা হা হা! তা তো সম্ভব না তবে ১৪ বছর আগের সেই উদ্দামকে তো ফেরানো যায়। যেই ভাবা সেই কাজ। এমন টা ১১ বছর আগেই হয়েছিল। নিজেদের মতো করে এগিয়ে যাওয়া।
রাইহান কে গাড়ি থামাতে বললাম। হাতে কয়েকটা হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম তোমার সপ্তাহ খানেক ছুটি। আমি পরে ফোনে ডেকে নেবো। মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে এমন। বেচারা রীতিমতো অবাক হয়ে গেছে। তবে ফ্যাকাসে মুখের আড়ালে একটা আবছায়া হাসি সাধারণকে হার মানাতে পারে ডাক্তার কে না।
নেহা কে ফোন দিলাম। বললাম কয়েক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। জরুরি কাজ। তবে ভয়ের কিছু না। ছোট্ট হাসি দিয়ে ফোনটা রাখলাম। হাজার প্রশ্নের উত্তর একটা হাসিতেই মিটে যায়।
গাড়ি ঘুরালাম। উদ্দেশ্য নিজে গিয়ে সবাই কে নিয়ে সেন্টমার্টিন যাওয়া। মিশন সেন্টমার্টিন। মৃনালকে ফোন দিলাম। ও তো অনেক খুশি। বললো বন্ধু তুই আয়। আমি রেডি। মেডিকেল লাইফে ওই ছিলো আমার বেস্ট বন্ধু। এখন আছে সিএমএইচ এ। নিয়ম মানতে নারাজ ছেলেটা এখন নিয়মবন্দী। ও হ্যাঁ আর একজন বেস্টি ছিলো ঐশী। তার কথায় পরে আসছি।
যাত্রা ভাগ করে নিলাম। প্রথমে খুলনা যাবো, ওখান থেকে ইকবল কে নিয়ে সোজা ঢাকা। বমির স্বভাবটা এতো দিনে গেছে হয়তো। ইকবল আমাদের কলেজেরই মাস্টার মশাই। এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ফিজিওলজি। পদ্মা সেতু দিয়েই যেতাম কিন্তু কুষ্টিয়া থেকে অনন্যাকে নেবো। ওর বর কুষ্টিয়ায় ইউএনও। অনন্যা কুষ্টিয়া সদরেই আছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি একটু কমতে শুরু করেছ। মেঘ এখনো কাটেনি। গাড়ি চলছে খুলনার দিকে। বিকেল হতে চললো। খুলনাতে পৌঁছেই খাবো। আল-আরাফা হোটেলে ঢোকা হয়না অনেক দিন। কি জানি! হোটেলটা আছে কি না। সেই ভর্তা!আহ!আজও ভুলতে পারিনা।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে খুলনা পৌঁছলাম। আল-আরাফা নাই!এখানে একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ হয়েছে। নাম, মুন লাইট ক্যাফে! আধুনিকতার ছোঁয়াতে হয়তো পুরাতন স্বাদের সবটাই হারিয়ে যাচ্ছে। কলেজটা ও এখন এখানে নাই! এটা হাসপাতালে অংশ হয়ে গেছে। কলেজ ময়ূর ব্রিজের ওখানে। পাশের একটা গলি রেস্তোরাঁ থেকে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিলাম। মেনু -কাচকি মাছ ,বেগুন ভাজি আর সাদা ভাত।
আজ শনিবার। ইকবাল কলেজেই আছে। রুমে ঢুকে দেখি গাইটোনে মুখ লুকানো তার। আমাকে দেখেই চোখ চকচকিয়ে উঠলো। চশমা পরা ইকবলকে বড্ড বেমানান মনে হচ্ছে আমার। বললাম, চল বের হবো। এক সপ্তাহ বাইরে থাকবো। আশ্চর্য! ছেলেটা কোন প্রশ্ন না করেই প্রিয়তাকে ফোন দিয়ে বললো, আমি বন্ধুদের সাথে বাইরে যাচ্ছি ফিরবো এক সপ্তাহ পর। যে ছেলেটা এক সময় ৩ তলা থেকে নামতেই অজুহাত খুঁজতো আজ সময় তাকে কতটা চেঞ্জ করেছে। দুজনেই মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম আমাদের কলেজ জীবনের বাসার পাশের ওই মসজিদটাতে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে মসজিদটা। এখন তিন তলা। সবটাই উজ্জ্বল টাইলস এ মোড়ানো। জুতা রাখার মস্ত একটা তাক। অজুখানা আরো বড়।
নামাজ শেষে বাইরে এসে দেখলাম ভাজা মামাকে। তার পরিবর্তন নেই। চেহারা হোক বা তার ঠেলা। আগের মতোই আছে। আমাকে দেখে চিনতে পারলো সে।
হাসি মাখা মুখে বললো, মামা আছো কেমন? আমি পাশে গেলাম। কাঁধে হাত রেখে বললাম অনেক দিন পর মামা! মুড়ি মাখান।
রওনা দেওয়ার আগে শাহাবুদ্দিন আঙ্কেল এর মুদি দোকান থেকে ঢুঁ মেরে এলাম। দোকান টা একই রকম আছে। তবে একটু সাজানো, ডিপ ফ্রিজ রাখা সামনে একটা। সম্ভবত আইসক্রিম রাখার জন্য।
৬:২০ নাগাদ খুলনা ছাড়লাম আমরা। চলছি, চলছি আর চলছি। ফেসবুকের বদৌলতে জানতে পারলাম,ডি এস যশোরেই আছে। ওর বাবার সেই বাড়িতেই। কি যেনো ছুটিতে আছে। হ্যাঁ ডি এস! হা হা হা! ও দেবাশিস সরকার। সংক্ষেপে ডিএস। এই নামটাতেই চিনতো সবাই ওকে। সবথেকে সিরিয়াস, কঠোর পরিশ্রমী ছেলেটা কিন্তু এখন ডাক্তারিই করে না। গোটা তিনেক প্রমোশন পেয়ে এখন নেত্রকোনার এডিসি। ডাক্তার শুধু নামের আগেই আছে। প্রায় ৮ টায় পৌঁছলাম ওর বাড়িতে। আন্টি তো বেজায় খুশি। ও প্রেসক্লাবের কি একটা প্রোগ্রামের বিশেষ অতিথি হিসেবে গেছে। ফোন দিলাম। আন্টির থেকে জানলাম নীহারিকা বাবার বাড়িতে গেছে। ও ডিএস এর বৌ।
ওপাশে, হ্যাঁ দোস্ত বল।
-শালা, আমি তোর বাড়িতে। দ্রুত আয়। ঘুরতে যাবো সবাই একসাথে।
অবিশ্বাসীদের সুরে একটা হাসি দিলো৷
ফোনটা আন্টির কাছে দিতেই বিশ্বাস হলো ওর। ২০ মিনিটেই ফিরে আসলো সে। সব প্লান শুনে কিছুক্ষণ ভাবলো। তার পর বললো ওকে চল।
রাতে আমি এখনো কমদেখি। কাজেই ড্রাইভ করছে ডিএস। রাস্তার বাঁকে বাঁকে ছোট্ট ঝুপড়ি দোকান গুলোতে আলোর ফোয়ারা। মাঝে মাঝে পাড়ি দিচ্ছি ছোট্ট ছোট্ট জটলা। এটাকে উপশহর বলা চলে। মাঝের আঁধার। ছুটে চলছি পিচ রাস্তা ধরে। এই দিকটাতে বৃষ্টি হয়নি মনে হচ্ছে। রাস্তার পাড় গুলো শুকনা খটখটে। আকাশটা ও বেশ পরিষ্কার। জানালা দিয়ে গুটিকয়েক তারা দেখা যাচ্ছে। ইকবল ঘুমিয়ে গেছে। আমারও চোখ লেগে যাচ্ছে। ডিএস নীরবে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। হয়তো বয়সে ভাঝে দুমড়ে গেছি আমরা। কলেজের দিনগুলোতে কখনো এমন নীরব মুহূর্ত গেছে কিনা মনে পড়ে না। প্রফেসর রেজাল্টের দিনগুলোতে যখন চিন্তায় স্নায়ু থেমে যেতো তখনও আমাদের আসর জমতো। আর আজ!
-এই শুভ। চুপ চাপ কেনো?
-আরে এমনিতেই। টায়ার্ড লাগছে বড্ড।
আমি বাবা ডিফেন্স এ গিয়ে কষ্ট ভুলে গেছি। হা হা হা। ওই ইকবল কি ঘুমায়?
-হ্যাঁ। ও কলেজ থেকেই এসেছে। খুব টায়ার্ড।
আমরা কি ডাইরেক্ট অনন্যার ওখানে যাচ্ছি?
হুম। কিন্তু আগে কিছু খাবো।
- ওকে একটা রেস্টুরেন্টে দেখে পার্ক কর।
মিনিট দশেক পর গাডি থামলো। সামনে মস্ত একটা ফুলের বাগান। চারিদিকে ঝলমলে আলো। হোটেল ফুড পার্ক। তিনজনই গেলাম ভিতরে। বিশাল হলরুম একে বারেই ফাকা। এসি সব অফ। তবে রকমারি আলো আর বন্ধ পরিবেশ একটা মায়ার সৃষ্টি করছে রুমটাতে। দেয়ালে রকমারি ডিজাইনে চোখ বুলাচ্ছি আমরা।
স্যার, অর্ডার প্লিজ করুন সুরে আওয়াজ ভেসে এলো। ছেলেটা লম্বা তবে একটু রং চাপা। আমার আর ডিএস এর মেন্যু ছিলো- ভাত, টাকি মাছ ভর্তা আর কবুতরের মাংস। মাস্টার এখনো স্বাস্থ্য সচেতন। শুধু একটা আইসক্রিমই নিলো ও।
আবার শুরু হলো। রাত ১:২০ নাগাদ আমারা কুষ্টিয়া। উপজেলা পরিষদ কর্ষক রেই বাংলো। বাংলো টা বেশ পুরাতন। ভুতুরে লাগছে এই রাতের আড়ালে। গেটে ২ জন কনস্টেবল আছে। গাড়ির আলো পড়তেই এগিয়ে এলো একজন।
-কি চাই?
-আমারা ম্যাডামের বন্ধু। ডাক দাওতো স্যার বা ম্যাডামকে।
-এতো রাতে!
-হুম। আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি।
বিড় বিড় করে কি যেন বললো। তার পর গেলো ওপরে। তেমন গা নাই মনে হলো। গড়িমসি গড়িমসি ভাব। দীপক বাবু বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখেই চিনতে পারলেন উনি। সেই বিয়েতে দেখা। তার পর তো আর কথাই হয় নাই।
আরে আপনি!
- জী। কেমন আছেন?
ভালো মানে অনেক ভালো। আসেন আসেন ভিতরে আসেন। এই অণু। অণু। বাইরে আসো ,দেখো কারা এসেছে!
খুশিতে তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। সে যেন এখনো বিশ্বাসই করতে পারছে না। অনন্যা বের হয়েই ও ভগবান বলে চেঁচিয়ে উঠলো। অন্ধকারের মাঝেও তার আনন্দ ফুটে উঠতে বিন্দু মাত্র অবজ্ঞা করলো না। আলাপচারিতা সেরে ভিতরে গেলাম।
- এই দেব দেবুদের রুম গুলো দেখিয়ে দাও। আমি রান্নার রুমে যাচ্ছি। অনন্যার প্রিয় নায়ক দেব এর আর এক নাম দীপক। তাই হয়তো অনন্যা ও তার বরের নাম চেঞ্জ করে দেব করে নিয়েছে। উল্টে পাল্টে নিল হয়তো! আর দেবু ডিএস এর ই নাম।
দেবু বললো ,আরে আমারা মাত্র খেয়ে এলাম। তুই রুম দেখা। আমরা ঘুমাবো। সেই টায়ার্ড। শাওয়ার নিয়েই ঘুমিয়ে গেলাম আমি। ইকবল আগেই ঘুম। ডিএস কি যেন করছে।
সকালে নাস্তার টেবিলে সবটা বললাম ওদের। দুজনেই খুশি। দিপক বাবু কে আমন্ত্রণ জানালাম। উনিও আগ্রহী। কিন্তু তার অণুর লাল চোখেই যে মহাশয় না বলে দিলেন বুঝতে বাকি নাই আমাদের। নাস্তা সেরেই রওনা দিলাম। এখন ৪ জন। আমিই ড্রাইভ করছি। অনন্যা আর ডিএস পিছে। ইকবাল আমার পাশের সিটে।
অন্যন্যা বললো ,এই বান্ধবীরে নিবিনা? ওতো পাশেই থাকে।
বান্ধবী হচ্ছে তন্নি, ডাঃ নিশাত শারমিন তন্নি। অন্যন্যা ওকে বান্ধবী বলে ডাকতো। সবাই ও ওই নামেই ডাকতো ওকে। তন্নির থেকেই বান্ধবী নামে বেশী পরিচিতি ওর।
- ও হ্যাঁ! আমি তো ভুলেই গেছিলাম! ইকবল বললো। অনন্যা শুরু করলো, বান্ধবী ফরিদপুর সদরে আছে। মেডিসিনে আছে। নিলয় ভাইয়াও একসাথে আছেন। উনি সার্জারিতে। ফোন দিয়ে জানতে পারলাম সে বাবার বাড়ি। ঈশ! আগে জানলে একসাথেই আসতে পারতাম! ডিএস বলে উঠলো৷
বান্ধবী সরাসরি কক্সবাজার মিলবে বলে কথা দিয়েছে।
মুনের কী খবর রে অনন্যা? ইকবাল নড়েচড়ে বসে প্রশ্নটা করলো।
-ও তো নিউইয়র্কে। ওখানেই স্থায়ী এখন। বর আর ও দুজনেই প্রাকটিস করে ওখানেই। অনন্যার উচ্চস্বরে উত্তর।
আর জাফরিয়া,দীপা ওরা?
- জাফরিয়ার খবর জানি না ,দিপা খুলনাতে আছে। ও প্রেগন্যান্ট। এটা ওর দ্বিতীয় বাবু। ও যেতে পারবেনা।
মেঘ আছে আকাশে। তবে সূর্য হাসছে এখনো। বৃষ্টি হতে পারে তবে ২-৩ ঘণ্টা তো রোদ থাকবে বলে দেওয়া যায়। চলছি আমরা ফেরিঘাট পাড়ে। ১০ টা নাগাদ দৌলতদিয়া ঘাটে পৌঁছলাম। জ্যাম নাই। তবে ফেরি ওপারে। ঘাটের চাচাটা বললো ৫ মিনিটেই আসবে ফেরি। হয়তো পদ্মা সেতুর জন্যই ঘাট এমন ফাঁকা। একটা সময় তো অপেক্ষার প্রহর কমতো না ফেরির জন্য।
ফেরিতে আমরা। ঘাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছি আমি। ইকবল গাড়িতেই। ডিএস ওপরে গেছে। অনন্যা আমার সাথেই আছে। আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার।
মাফি! আমরা এখন কই যাচ্ছি? অনন্যার কৌতূহল ভরা প্রশ্ন।
-ঢাকা যাবো। মৃনাল কে নিবো আগে। মৃনাল না হলে প্লানই মিলছে না আমার। মাফি আমারই নাম। এটা ঐসব এর দেওয়া। কলেজে মাফি নামটাই বেশি চলতো। ঐসব আমার সেই বেস্ট ফ্রেন্ডটা। পুরোনাম ঐশ্বর্য বালা। কলেজের সবথেকে বেস্ট বন্ধুটার সাথেও দেখা হয়েছিলো ৪ বছর আগে। নেপালে একটা মেডিকেল ক্যাম্প এ। ও এসেছিলো WHO থেকে, আমি স্বেচ্ছাসেবক টিমের সাথে গেছিলাম। ভূমিকম্পটা বেশ শক্তিশালী ছিলো। সারা পৃথিবীতে একটা সাহায্যের দরকার পড়ে গেছিলো।
ক্যারিয়ার এর শুরুতেই ও প্রথমেই বিসিএস এ টিকে যাই। কপাল জোর মায়ের হাসপাতালেই পোস্টিং হয় ওর। মায়ের সাথে কাজ করার ইচ্ছাটা পূরণ হয় ওর, কিন্তু স্থায়ী না। WHO এর হয়ে কাজ করেছে কয় বছর। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ক্যাম্প, ট্রেনিং। এখন নিপসন এ বাংলাদেশের ডেপুটি ডাইরেক্টর। কক্সবাজারে আছে ৬ মাস ধরেই। কি যেন একটা প্রজেক্ট। ওর বর নামকরা প্রফেসর। ডাঃ সঞ্জীব দত্ত। নিউরোলজি, এমএমসি।
ও হ্যাঁ ,নেপালের ট্রিপটাতে আরো একজনের সাথে দেখা হয়ে ছিল। ফাতা। মেয়েটা কে দেখেই জীবনে প্রথমবারের মতো মনে হয়েছিলো ডাক্তারি পেশা আসলেই মহান। যে মেয়েটা ওয়ার্ড এ মামাকে এক্সামিন করে হাতে লোশন দিতে ভুলতো না, যে কিনা পারসোনাল হাইজিন নিয়ে সব থেকে স্ট্রেইট ছিলো। সেই ফ্যাতাহ! রুগ্ন পাহাড়ি নেপালিদের একেবারে মিশে গিয়ে সেবা দিচ্ছে। চোখটা ভিজে এসেছিলো যখন জানতে পারলাম ও নিজেই ব্যক্তিগত ভাবেই এসেছে এখানে। এতোটা চেঞ্জ তো শুধু ডাক্তার দের জন্যই সম্ভব। মেডিকেল তুমি সত্যই মহান। মেয়েটা এখন পোষ্ট গ্রাজুয়েশন এর জন্য অস্ট্রেলিয়া আছে।
ফেরি থেকে নেমে আবার যথারীতি সামনে এগিয়ে যাওয়া। এবার ড্রাইভিং অনন্যা করছে। আমি পিছে। ইকবল ডিএস তাদের জাইগাতেই আছে। রাস্তাটা বেশ ফাকা। ঠাণ্ডা কম আছে এই দিকটাতে।
১২:৩০ এ মৃনালের ওখানে পৌঁছলাম। গাডি থামতেই ঘুম ভাঙলো আমার। লম্বা ঘুম দিয়েছি। মৃনালকে আগেই বলাছিল। ভিতরে যেতেই ও জড়িয়ে ধরলো আমাকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ! আড়ালে চোখটা মুছেই সবার সাথে কথা বলা শুরু করলো। দেহের স্নায়ু গুলো কেমন যেন করছে। লোম গুলো আলোড়িত! মধ্যাহ্নভোজন এর পর রওনা দিলাম।
মৃনাল অনন্যা আর আমি পিছে। ডিএস ড্রাইভ করছে।
মৃনাল বলল, আমরা আগে রংপুর যাবো। ওখানে ধ্রব, নাতাশা আছে।
ইকবল বলল, তাহলে গাইবান্ধা থেকে সম্পদকে ও নিয়ে আসবো।
সম্পদ। পাশের রুমে থাকা ছেলেটাকে তো ভুলেই গেছিলাম। ইস! কতো স্মৃতি আছে একসাথে।
ধ্রুব রংপুর থাকে। নাতাশা বগুড়া। বিয়ে করে নাই ওরা। পরিবারের কথা ভেবেই তারা বিয়ে করে নাই এখনো। তবে তাদের বন্ধুত্বটা আগের মতোই আছে। হয়তো কোনও অদৃশ্য বন্ধন বা কোনও অদৃশ্য বিশ্বাস এ মুড়িয়ে আছে দুইজন। কথা ,হাসি ,মজা চলছে। সাথে চলছে আমাদের বহন যান। রাস্তাটা বেশ ব্যস্ত। দুপাশে ফাঁকা বিল আর মাঝে মাঝে নীলচে সাদা পানির মিছিল। বেশ লাগছে আমার। বিকেল হয়েই এলো। বগুড়া তে আমরা। নাতাশার বাসা চিনিনা। ফোন দিয়ে ওকে আসতে বললো মৃনাল। ও টিএমএসএস এ আছে। এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, মাইক্রবায়োলজি।
আমরা অপেক্ষা করছি সাতমাথার পাশে। ১৪ বছর আগের বগুড়ার সাথে এখন এর ততোটা পার্থক্য চোখে পড়ে না। সারা দেশ যখন পরিবর্তনের মিছিলে মশগুল বগুড়ায় তখন গুটিকয়েক ভবনই উঠেছে শুধু রাজনৈতিক প্রভাব হবে হয়তো! নীলচে টয়োটা এসে থামলো আমাদের পাশে। নাতাশা বেরিয়ে এলো। মেয়েটা এখনো পিচ্চি। মিষ্টি হাসিটা এখনো আছে মুখে। খুবই স্বাভাবিক থাকার ভঙ্গিতে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু টিস্যু দিয়ে দুইবার চোখের কোনাটা মুছেনিতে আমি দেখে ফেললাম।
মানুষ বেড়ে যাচ্ছে। কাজেই নীলচে গাড়িটাও আমাদের সফরে যুক্ত হয়ে গেলো। আমি মৃণাল অনন্যা আর নাতাশা একটাতে। আর ওরা দুইজন অন্যটা তে। রংপুরে চলে এলাম। নাতাশা আগেই ধ্রবকে জানিয়ে রেখেছে। কাজেই ও রেডি হয়েই অপেক্ষা করছিলো। ধ্রুব রংপুর মেডিকেলে আছে। মেডিকেল অফিসার। খুব স্বাভাবিক ভাবেই শেষ হলো আলাপচারিতা। নিষিদ্ধ কথাটা ২-৪ কানে ভেসে এলো আমার। যাচ্ছি সম্পদকে নিতে। গাইবান্ধা পৌঁছেই সম্পদকে ফোন দিলাম। নম্বর সুইচ অফ কয়! তবে বেচারাকে খুঁজতে বেশি সময় লাগলোনা। নাম বলত সবাই চেনে ওকে। শুনলাম সে বিএমএর স্থানীয় নেতা। নাম করা ক্লিনিকও খুলেছে সে। ডাক্তারি থেকে রাজনীতিতে ঝুঁকে আছে বেশি।
আমাদের দেখেই সে বাকযুদ্ধ। আসলে কখনো কল্পনাতেও ভাবেনি সবাইকে এভাবে একসাথে দেখবে। এই ট্রিপের সবথেকে অবাক করা ব্যাপার ছিলো সম্পদের বৌ কে যখন সে ডাকলো। সবারই চোখ ছানাবড়া। তুমি! পরিচিত মুখ সবারই। সম্পদের ক্রাশ সেই ধনীর দুলালী। না মটা না হয় না ই বললাম। দুইজনেই আসলো আমাদের সাথে। রাতে থাকার জন্য খুব জোর করছিলো কিন্তু ট্রিপের সময় অল্প হওয়ায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা। এখন সংখ্যায় ৯ । আমি, সম্পদ, ডি এস আর ইকবাল একটা গাড়িতে। বাকিরা অন্য গাড়িতে।
সন্ধ্যা! চারিদিকে আঁধার নেমে গেছে। রাস্তার পাশে ততো আলো নাই তবে আজ আকাশ ঝলমলে তারায় পূর্ণ। দুপাশের আঁধার কেটে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। রাতে মৃণালের কোয়ার্টারে থাকবো। সকালে আবার যাত্রা। দুপুর নাগাত কক্সবাজার। নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো সম্পদ। হাসি দিয়ে প্রশ্ন করলো ভাইয়া, সবাই যাচ্ছে!
ইকবাল বলল, যারা দেশে আছে আর যাদের যাওয়া সম্ভব সবাই যাচ্ছে।
সম্পদ বলল, সৃষ্টি?
হকচকিয়ে গেলো সবাই। আমি নিজেই তো ভুলে গেছিলাম মেয়েটাকে। একটা সময়ে বন্ধুত্বের মাপকাঠি ছাড়িয়ে ওপরে চলে গিয়েছিল সে। তারপর। থাক না আজ। এই ট্রিপে ওই স্মৃতি নাই বা মনে করলাম। অন্য একদিন বলবো তার কথা। তবে বন্ধু হিসেবে তাকে নেওয়া যেতেই পারে। অবশ্য সে যদি চায় আর অনুমতি পায়। শুনেছি সে নাকি মোহাম্মদপুর থাকে। নেহাল টেলিটক কোম্পানিতে সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছে। সৃষ্টি একটা বেসরকারি ক্লিনিকে প্রাকটিস করে। শিশু বিশেষজ্ঞ। ভাবলাম মৃণাল কে নিয়ে ভোরে একবার যাবো ওর ওখানে। রাত ১১ টায় ঢাকা পৌঁছলাম। মৃণালের কোয়ার্টার বেশ বড়। ৯ জন থাকতে অসুবিধা হলো না।
ভোর ৫:০০। আমি আর মৃণাল রওনা দিলাম। কুয়াশার আজ বেশী মনে হচ্ছে। ঠাণ্ডা ও একটু বেশি। কলিং বাজতেই দরজা খুললও একটা মেয়ে। বাড়ির সাহায্যকারী হবে হয়তো। বললাম ভাইয়া বা আফা কাউরে ডেকে দাও। নেহাল বাইরে আসলো। এতোটাই অবাক হয়েছে যে রেগে গেলো না খুশি হলো সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। তবে খুশি হওয়ার কারণ ছিলো না এটা বাজি ধরেই বলতে পারি। সৃষ্টি আসলো। আমরা ভিতরে গিয়ে বসলাম। পুরোটা সময় আমি চুপ ছিলাম। কথা সব মৃণালই বললো। বার দুয়েক তাকিয়েছিলাম সৃষ্টির চোখের দিকে। ও স্বাভাবিক ই ছিলো। সবকিছু শোনার পর নেহাল যথারীতি রাজি হবে না। সৃষ্টি আজ ও চুপচাপ। হয়তো ভালোবাসার অধিকার। যাই হোক আমরা ওখান থেকে রওনা দিলাম। বাসায় ফিরে দেখি সবাই ই প্রস্তুত। কই গেছিলাম জানতে চাইলে এড়িয়ে গেলো মৃণাল। বললো হাওয়া খাইতে গেছিলাম।
সকাল ৮ টাতে রওনা হলাম আমরা। এবার আমি মৃণাল, ধ্রুব্ , নাতাশা আর অনন্যা একটাতে বাকি ৪ জন অন্যটাতে। আজ আকাশ বেশ পরিষ্কার। ঝলমলে রোদ। দুপাশে সারি সারি গাছ। কিছু মুহূর্ত পর পর সাঁ সাঁ করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে বড় বড় ট্রাক। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে এগিয়ে চলেছে আমাদের আড্ডা। আড্ডা এখন বেশ জমতে শুরু করেছে। কাল হয়তো ১১ বছরের গ্যাপটাই আমাদের একটু দুরে রেখেছিলো। আজ সেই আগের আমরা হয়ে গেছি। এই ট্রিপটা তে শুধু বাদ থেকে গেলো জাফরিয়া আর দুর্জয়। দুর্জয় ইন্ডিয়া গেছে। ফ্যামলি ট্যুরে। আর জাফরিয়ার খবর কেউ জানে না। নম্বরটা ও চেঞ্জ করেছে মেয়েটা।
পাহাড়ি ছায়া আর বন পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা দিগন্ত পানে। বেশ খুশি সবাই। দুপুর ১ টা। আমরা কক্সবাজার। গাড়ি ঢুকলো নিপসম এর গেট দিয়ে। ভিতরটা বেশ সাজানো। ফুলের বাগান। কিছু ভেষজ গাছও আছে। গাড়ি থেকে নামতেই গার্ড এর আগমন। আপনারা কই থেকে এসেছেন স্যার? মৃদু কণ্ঠে আওয়াজ। হয়তো কারো আসার অপেক্ষা করছিল সে। আমার মুখে ঢাকা শুনেই মুখ কালো করে ফিরে গেলো গেইটে।
আমরা গেলাম ঐশ -এর রুমে। আমাদের দেখে বেচারি কেঁদেই দিলো। কিছুক্ষণ চললো মৃদু আলাপচারিতা। তার পর অট্টহাসির রোল পড়ে গেলো। প্লান শুনে সে মহা খুশি কিন্তু আজ ইউনেস্কো থেকে ভিজিটিং টিম আসছে বলে জানালোও। বুঝলাম দারোয়ান তাদেরই অপেক্ষা করছিল। ঐশ কাল বের হওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করলো। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। আজ কক্সবাজার বিচে যাবো সে প্লানই।
বিকালে বিচে গেলাম আমরা। একসাথে আগেও আসা হয়েছে সাগর-পাড়ে। সেই ১৫ বছর আগে থার্ড ইয়ারে থাকাকালীন। তবে আজ একটু ভিন্ন, পরিপূর্ণ আমরা। তবে মজা হোক বা উপভোগ ওদিন কে হারাবে সেই সাধ্য আজ আমাদের নেই। বয়সের আড়ালে হারিয়েছে তারুণ্য। সন্ধ্যায় ফিরলাম গেস্ট হাউজে। ঐশ আমাদের সাথেই আছে এখন। রাতে ক্যাম্প ফায়ারিং হলো। ছোট্ট একটা জলসাও হলো।
সকাল ৭:২৫। আমারা রওনা হচ্ছি গন্তব্যে। সবাই মিলে ঠাসাঠাসি করে উঠলাম চাদের গাড়িতে। জ্বীপ টাইপের গাড়ি তবে কোনও ছাউনি নাই গাড়িটাতে। ডিএস গান শুরু করলো। এই পথ যদি না শেষ হয় . . . . . . . . .
আমরা চলছি মেরিন ড্রাইভ দিয়ে। একপাশে দিগন্ত জোড়া সাগর আর তার উপচে পড়া ঢেঊ আর অন্য পাশে পাহাড় , বন ,ঝর্ণা আসছে পালাক্রমে। সবাই উপভোগ করছে ভ্রমণ। সবার মুখেই এক চিলতে হাসি। টেকনাফে আছে নিপসমের জাহাজ। ওটাতেই যাবো আমরা। ঐস ব্যবস্থা করে রেখেছে।
৩ ঘণ্টা পর পৌঁছে যাবো সেন্টমার্টিন। তার পর আনন্দ শেষে ফিরবো সবাই। কাল থেকে আবার যে যার মতো ব্যাস্ত হয়ে যাবো। হয়তো আবার কেটে যাবে ১১ বছর। হয়তো বা আরো বেশি। হয়তো আমার কখনো মিলবো আমরা। কোন এক ১১ বছর পর। বয়সের ভারে আরো দুমড়ে যাবো তখন। হয়তো তখন লিখবে নতুন প্রজন্ম।
চোখটা ছলছল করছে। মুছে নিয়ে তাকিয়ে আছি দিগন্তেজোড়া সাগরের দিকে। গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, ছুটে যাচ্ছে গন্তব্যে।
রাইহান আমার ড্রাইভার। কাজেই অযথা দেরি করা অনুচিৎ মনে হলো। তাছাড়া হাসপাতাল পাড়ায় এমন হট্টগোল এখন প্রতিবেলার ব্যাপার। ডাক্তার আর রোগী এখন যেন চিরশত্রু! একটা সময় ছিলো, যখন জটলা দেখলেই এগিuয়ে যেতাম। কখনো থাকতো আগ্রহ আবার কখন কৌতূহল। জটলাটা উপভোগ করতাম আমরা। ঢাকার মানুষেরা যেমন গো গ্রামের পুকুর উপভোগ করে এমনই উপভোগ। কথাটা ধ্রুব বলতো। ও ঢাকাইয়া।
ও হ্যাঁ , আমার পরিচয়টাই তো দেওয়া হলো না। আমি শুভ। এখানকারই রেজিস্ট্রার। অনিক আমার মেডিকেল লাইফের বন্ধু। গাড়ি ছুটে চলছে চেম্বারে দিকে। রাইহান বললো, স্যার, দুই বন্ধু মারামারি কইরা আইছে। তাদের দুই পক্ষেরই হট্টগোল। দুইজনই ইলেকশনে যাবে। বন্ধু! কথাটা শুনেই যেন কেমন একটা লাগলো।
শীতের দিনে বৃষ্টি গুলো এমনই। মনে করিয়ে দেয় সেই পুরানো স্মৃতিকথা। মেডিকেল প্রফেশনে থেকেও মেডিকেল লাইফের বন্ধুদের সাথে দেখা হয়না কতদিন। এই কয় বছরে প্রত্যেকের সাথে ২-৪ বার দেখা হলেও এক সাথে বসা হয়না ১১ বছর। রি ইউনিয়নের প্লান হয়েছিলো কইবার কিন্তু শেষ নামেনাই। আজ কেন যেন ১৪ বছর আগে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। হা হা হা! তা তো সম্ভব না তবে ১৪ বছর আগের সেই উদ্দামকে তো ফেরানো যায়। যেই ভাবা সেই কাজ। এমন টা ১১ বছর আগেই হয়েছিল। নিজেদের মতো করে এগিয়ে যাওয়া।
রাইহান কে গাড়ি থামাতে বললাম। হাতে কয়েকটা হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম তোমার সপ্তাহ খানেক ছুটি। আমি পরে ফোনে ডেকে নেবো। মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে এমন। বেচারা রীতিমতো অবাক হয়ে গেছে। তবে ফ্যাকাসে মুখের আড়ালে একটা আবছায়া হাসি সাধারণকে হার মানাতে পারে ডাক্তার কে না।
নেহা কে ফোন দিলাম। বললাম কয়েক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। জরুরি কাজ। তবে ভয়ের কিছু না। ছোট্ট হাসি দিয়ে ফোনটা রাখলাম। হাজার প্রশ্নের উত্তর একটা হাসিতেই মিটে যায়।
গাড়ি ঘুরালাম। উদ্দেশ্য নিজে গিয়ে সবাই কে নিয়ে সেন্টমার্টিন যাওয়া। মিশন সেন্টমার্টিন। মৃনালকে ফোন দিলাম। ও তো অনেক খুশি। বললো বন্ধু তুই আয়। আমি রেডি। মেডিকেল লাইফে ওই ছিলো আমার বেস্ট বন্ধু। এখন আছে সিএমএইচ এ। নিয়ম মানতে নারাজ ছেলেটা এখন নিয়মবন্দী। ও হ্যাঁ আর একজন বেস্টি ছিলো ঐশী। তার কথায় পরে আসছি।
যাত্রা ভাগ করে নিলাম। প্রথমে খুলনা যাবো, ওখান থেকে ইকবল কে নিয়ে সোজা ঢাকা। বমির স্বভাবটা এতো দিনে গেছে হয়তো। ইকবল আমাদের কলেজেরই মাস্টার মশাই। এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ফিজিওলজি। পদ্মা সেতু দিয়েই যেতাম কিন্তু কুষ্টিয়া থেকে অনন্যাকে নেবো। ওর বর কুষ্টিয়ায় ইউএনও। অনন্যা কুষ্টিয়া সদরেই আছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি একটু কমতে শুরু করেছ। মেঘ এখনো কাটেনি। গাড়ি চলছে খুলনার দিকে। বিকেল হতে চললো। খুলনাতে পৌঁছেই খাবো। আল-আরাফা হোটেলে ঢোকা হয়না অনেক দিন। কি জানি! হোটেলটা আছে কি না। সেই ভর্তা!আহ!আজও ভুলতে পারিনা।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে খুলনা পৌঁছলাম। আল-আরাফা নাই!এখানে একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ হয়েছে। নাম, মুন লাইট ক্যাফে! আধুনিকতার ছোঁয়াতে হয়তো পুরাতন স্বাদের সবটাই হারিয়ে যাচ্ছে। কলেজটা ও এখন এখানে নাই! এটা হাসপাতালে অংশ হয়ে গেছে। কলেজ ময়ূর ব্রিজের ওখানে। পাশের একটা গলি রেস্তোরাঁ থেকে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিলাম। মেনু -কাচকি মাছ ,বেগুন ভাজি আর সাদা ভাত।
আজ শনিবার। ইকবাল কলেজেই আছে। রুমে ঢুকে দেখি গাইটোনে মুখ লুকানো তার। আমাকে দেখেই চোখ চকচকিয়ে উঠলো। চশমা পরা ইকবলকে বড্ড বেমানান মনে হচ্ছে আমার। বললাম, চল বের হবো। এক সপ্তাহ বাইরে থাকবো। আশ্চর্য! ছেলেটা কোন প্রশ্ন না করেই প্রিয়তাকে ফোন দিয়ে বললো, আমি বন্ধুদের সাথে বাইরে যাচ্ছি ফিরবো এক সপ্তাহ পর। যে ছেলেটা এক সময় ৩ তলা থেকে নামতেই অজুহাত খুঁজতো আজ সময় তাকে কতটা চেঞ্জ করেছে। দুজনেই মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম আমাদের কলেজ জীবনের বাসার পাশের ওই মসজিদটাতে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে মসজিদটা। এখন তিন তলা। সবটাই উজ্জ্বল টাইলস এ মোড়ানো। জুতা রাখার মস্ত একটা তাক। অজুখানা আরো বড়।
নামাজ শেষে বাইরে এসে দেখলাম ভাজা মামাকে। তার পরিবর্তন নেই। চেহারা হোক বা তার ঠেলা। আগের মতোই আছে। আমাকে দেখে চিনতে পারলো সে।
হাসি মাখা মুখে বললো, মামা আছো কেমন? আমি পাশে গেলাম। কাঁধে হাত রেখে বললাম অনেক দিন পর মামা! মুড়ি মাখান।
রওনা দেওয়ার আগে শাহাবুদ্দিন আঙ্কেল এর মুদি দোকান থেকে ঢুঁ মেরে এলাম। দোকান টা একই রকম আছে। তবে একটু সাজানো, ডিপ ফ্রিজ রাখা সামনে একটা। সম্ভবত আইসক্রিম রাখার জন্য।
৬:২০ নাগাদ খুলনা ছাড়লাম আমরা। চলছি, চলছি আর চলছি। ফেসবুকের বদৌলতে জানতে পারলাম,ডি এস যশোরেই আছে। ওর বাবার সেই বাড়িতেই। কি যেনো ছুটিতে আছে। হ্যাঁ ডি এস! হা হা হা! ও দেবাশিস সরকার। সংক্ষেপে ডিএস। এই নামটাতেই চিনতো সবাই ওকে। সবথেকে সিরিয়াস, কঠোর পরিশ্রমী ছেলেটা কিন্তু এখন ডাক্তারিই করে না। গোটা তিনেক প্রমোশন পেয়ে এখন নেত্রকোনার এডিসি। ডাক্তার শুধু নামের আগেই আছে। প্রায় ৮ টায় পৌঁছলাম ওর বাড়িতে। আন্টি তো বেজায় খুশি। ও প্রেসক্লাবের কি একটা প্রোগ্রামের বিশেষ অতিথি হিসেবে গেছে। ফোন দিলাম। আন্টির থেকে জানলাম নীহারিকা বাবার বাড়িতে গেছে। ও ডিএস এর বৌ।
ওপাশে, হ্যাঁ দোস্ত বল।
-শালা, আমি তোর বাড়িতে। দ্রুত আয়। ঘুরতে যাবো সবাই একসাথে।
অবিশ্বাসীদের সুরে একটা হাসি দিলো৷
ফোনটা আন্টির কাছে দিতেই বিশ্বাস হলো ওর। ২০ মিনিটেই ফিরে আসলো সে। সব প্লান শুনে কিছুক্ষণ ভাবলো। তার পর বললো ওকে চল।
রাতে আমি এখনো কমদেখি। কাজেই ড্রাইভ করছে ডিএস। রাস্তার বাঁকে বাঁকে ছোট্ট ঝুপড়ি দোকান গুলোতে আলোর ফোয়ারা। মাঝে মাঝে পাড়ি দিচ্ছি ছোট্ট ছোট্ট জটলা। এটাকে উপশহর বলা চলে। মাঝের আঁধার। ছুটে চলছি পিচ রাস্তা ধরে। এই দিকটাতে বৃষ্টি হয়নি মনে হচ্ছে। রাস্তার পাড় গুলো শুকনা খটখটে। আকাশটা ও বেশ পরিষ্কার। জানালা দিয়ে গুটিকয়েক তারা দেখা যাচ্ছে। ইকবল ঘুমিয়ে গেছে। আমারও চোখ লেগে যাচ্ছে। ডিএস নীরবে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। হয়তো বয়সে ভাঝে দুমড়ে গেছি আমরা। কলেজের দিনগুলোতে কখনো এমন নীরব মুহূর্ত গেছে কিনা মনে পড়ে না। প্রফেসর রেজাল্টের দিনগুলোতে যখন চিন্তায় স্নায়ু থেমে যেতো তখনও আমাদের আসর জমতো। আর আজ!
-এই শুভ। চুপ চাপ কেনো?
-আরে এমনিতেই। টায়ার্ড লাগছে বড্ড।
আমি বাবা ডিফেন্স এ গিয়ে কষ্ট ভুলে গেছি। হা হা হা। ওই ইকবল কি ঘুমায়?
-হ্যাঁ। ও কলেজ থেকেই এসেছে। খুব টায়ার্ড।
আমরা কি ডাইরেক্ট অনন্যার ওখানে যাচ্ছি?
হুম। কিন্তু আগে কিছু খাবো।
- ওকে একটা রেস্টুরেন্টে দেখে পার্ক কর।
মিনিট দশেক পর গাডি থামলো। সামনে মস্ত একটা ফুলের বাগান। চারিদিকে ঝলমলে আলো। হোটেল ফুড পার্ক। তিনজনই গেলাম ভিতরে। বিশাল হলরুম একে বারেই ফাকা। এসি সব অফ। তবে রকমারি আলো আর বন্ধ পরিবেশ একটা মায়ার সৃষ্টি করছে রুমটাতে। দেয়ালে রকমারি ডিজাইনে চোখ বুলাচ্ছি আমরা।
স্যার, অর্ডার প্লিজ করুন সুরে আওয়াজ ভেসে এলো। ছেলেটা লম্বা তবে একটু রং চাপা। আমার আর ডিএস এর মেন্যু ছিলো- ভাত, টাকি মাছ ভর্তা আর কবুতরের মাংস। মাস্টার এখনো স্বাস্থ্য সচেতন। শুধু একটা আইসক্রিমই নিলো ও।
আবার শুরু হলো। রাত ১:২০ নাগাদ আমারা কুষ্টিয়া। উপজেলা পরিষদ কর্ষক রেই বাংলো। বাংলো টা বেশ পুরাতন। ভুতুরে লাগছে এই রাতের আড়ালে। গেটে ২ জন কনস্টেবল আছে। গাড়ির আলো পড়তেই এগিয়ে এলো একজন।
-কি চাই?
-আমারা ম্যাডামের বন্ধু। ডাক দাওতো স্যার বা ম্যাডামকে।
-এতো রাতে!
-হুম। আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি।
বিড় বিড় করে কি যেন বললো। তার পর গেলো ওপরে। তেমন গা নাই মনে হলো। গড়িমসি গড়িমসি ভাব। দীপক বাবু বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখেই চিনতে পারলেন উনি। সেই বিয়েতে দেখা। তার পর তো আর কথাই হয় নাই।
আরে আপনি!
- জী। কেমন আছেন?
ভালো মানে অনেক ভালো। আসেন আসেন ভিতরে আসেন। এই অণু। অণু। বাইরে আসো ,দেখো কারা এসেছে!
খুশিতে তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। সে যেন এখনো বিশ্বাসই করতে পারছে না। অনন্যা বের হয়েই ও ভগবান বলে চেঁচিয়ে উঠলো। অন্ধকারের মাঝেও তার আনন্দ ফুটে উঠতে বিন্দু মাত্র অবজ্ঞা করলো না। আলাপচারিতা সেরে ভিতরে গেলাম।
- এই দেব দেবুদের রুম গুলো দেখিয়ে দাও। আমি রান্নার রুমে যাচ্ছি। অনন্যার প্রিয় নায়ক দেব এর আর এক নাম দীপক। তাই হয়তো অনন্যা ও তার বরের নাম চেঞ্জ করে দেব করে নিয়েছে। উল্টে পাল্টে নিল হয়তো! আর দেবু ডিএস এর ই নাম।
দেবু বললো ,আরে আমারা মাত্র খেয়ে এলাম। তুই রুম দেখা। আমরা ঘুমাবো। সেই টায়ার্ড। শাওয়ার নিয়েই ঘুমিয়ে গেলাম আমি। ইকবল আগেই ঘুম। ডিএস কি যেন করছে।
সকালে নাস্তার টেবিলে সবটা বললাম ওদের। দুজনেই খুশি। দিপক বাবু কে আমন্ত্রণ জানালাম। উনিও আগ্রহী। কিন্তু তার অণুর লাল চোখেই যে মহাশয় না বলে দিলেন বুঝতে বাকি নাই আমাদের। নাস্তা সেরেই রওনা দিলাম। এখন ৪ জন। আমিই ড্রাইভ করছি। অনন্যা আর ডিএস পিছে। ইকবাল আমার পাশের সিটে।
অন্যন্যা বললো ,এই বান্ধবীরে নিবিনা? ওতো পাশেই থাকে।
বান্ধবী হচ্ছে তন্নি, ডাঃ নিশাত শারমিন তন্নি। অন্যন্যা ওকে বান্ধবী বলে ডাকতো। সবাই ও ওই নামেই ডাকতো ওকে। তন্নির থেকেই বান্ধবী নামে বেশী পরিচিতি ওর।
- ও হ্যাঁ! আমি তো ভুলেই গেছিলাম! ইকবল বললো। অনন্যা শুরু করলো, বান্ধবী ফরিদপুর সদরে আছে। মেডিসিনে আছে। নিলয় ভাইয়াও একসাথে আছেন। উনি সার্জারিতে। ফোন দিয়ে জানতে পারলাম সে বাবার বাড়ি। ঈশ! আগে জানলে একসাথেই আসতে পারতাম! ডিএস বলে উঠলো৷
বান্ধবী সরাসরি কক্সবাজার মিলবে বলে কথা দিয়েছে।
মুনের কী খবর রে অনন্যা? ইকবাল নড়েচড়ে বসে প্রশ্নটা করলো।
-ও তো নিউইয়র্কে। ওখানেই স্থায়ী এখন। বর আর ও দুজনেই প্রাকটিস করে ওখানেই। অনন্যার উচ্চস্বরে উত্তর।
আর জাফরিয়া,দীপা ওরা?
- জাফরিয়ার খবর জানি না ,দিপা খুলনাতে আছে। ও প্রেগন্যান্ট। এটা ওর দ্বিতীয় বাবু। ও যেতে পারবেনা।
মেঘ আছে আকাশে। তবে সূর্য হাসছে এখনো। বৃষ্টি হতে পারে তবে ২-৩ ঘণ্টা তো রোদ থাকবে বলে দেওয়া যায়। চলছি আমরা ফেরিঘাট পাড়ে। ১০ টা নাগাদ দৌলতদিয়া ঘাটে পৌঁছলাম। জ্যাম নাই। তবে ফেরি ওপারে। ঘাটের চাচাটা বললো ৫ মিনিটেই আসবে ফেরি। হয়তো পদ্মা সেতুর জন্যই ঘাট এমন ফাঁকা। একটা সময় তো অপেক্ষার প্রহর কমতো না ফেরির জন্য।
ফেরিতে আমরা। ঘাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছি আমি। ইকবল গাড়িতেই। ডিএস ওপরে গেছে। অনন্যা আমার সাথেই আছে। আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার।
মাফি! আমরা এখন কই যাচ্ছি? অনন্যার কৌতূহল ভরা প্রশ্ন।
-ঢাকা যাবো। মৃনাল কে নিবো আগে। মৃনাল না হলে প্লানই মিলছে না আমার। মাফি আমারই নাম। এটা ঐসব এর দেওয়া। কলেজে মাফি নামটাই বেশি চলতো। ঐসব আমার সেই বেস্ট ফ্রেন্ডটা। পুরোনাম ঐশ্বর্য বালা। কলেজের সবথেকে বেস্ট বন্ধুটার সাথেও দেখা হয়েছিলো ৪ বছর আগে। নেপালে একটা মেডিকেল ক্যাম্প এ। ও এসেছিলো WHO থেকে, আমি স্বেচ্ছাসেবক টিমের সাথে গেছিলাম। ভূমিকম্পটা বেশ শক্তিশালী ছিলো। সারা পৃথিবীতে একটা সাহায্যের দরকার পড়ে গেছিলো।
ক্যারিয়ার এর শুরুতেই ও প্রথমেই বিসিএস এ টিকে যাই। কপাল জোর মায়ের হাসপাতালেই পোস্টিং হয় ওর। মায়ের সাথে কাজ করার ইচ্ছাটা পূরণ হয় ওর, কিন্তু স্থায়ী না। WHO এর হয়ে কাজ করেছে কয় বছর। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ক্যাম্প, ট্রেনিং। এখন নিপসন এ বাংলাদেশের ডেপুটি ডাইরেক্টর। কক্সবাজারে আছে ৬ মাস ধরেই। কি যেন একটা প্রজেক্ট। ওর বর নামকরা প্রফেসর। ডাঃ সঞ্জীব দত্ত। নিউরোলজি, এমএমসি।
ও হ্যাঁ ,নেপালের ট্রিপটাতে আরো একজনের সাথে দেখা হয়ে ছিল। ফাতা। মেয়েটা কে দেখেই জীবনে প্রথমবারের মতো মনে হয়েছিলো ডাক্তারি পেশা আসলেই মহান। যে মেয়েটা ওয়ার্ড এ মামাকে এক্সামিন করে হাতে লোশন দিতে ভুলতো না, যে কিনা পারসোনাল হাইজিন নিয়ে সব থেকে স্ট্রেইট ছিলো। সেই ফ্যাতাহ! রুগ্ন পাহাড়ি নেপালিদের একেবারে মিশে গিয়ে সেবা দিচ্ছে। চোখটা ভিজে এসেছিলো যখন জানতে পারলাম ও নিজেই ব্যক্তিগত ভাবেই এসেছে এখানে। এতোটা চেঞ্জ তো শুধু ডাক্তার দের জন্যই সম্ভব। মেডিকেল তুমি সত্যই মহান। মেয়েটা এখন পোষ্ট গ্রাজুয়েশন এর জন্য অস্ট্রেলিয়া আছে।
ফেরি থেকে নেমে আবার যথারীতি সামনে এগিয়ে যাওয়া। এবার ড্রাইভিং অনন্যা করছে। আমি পিছে। ইকবল ডিএস তাদের জাইগাতেই আছে। রাস্তাটা বেশ ফাকা। ঠাণ্ডা কম আছে এই দিকটাতে।
১২:৩০ এ মৃনালের ওখানে পৌঁছলাম। গাডি থামতেই ঘুম ভাঙলো আমার। লম্বা ঘুম দিয়েছি। মৃনালকে আগেই বলাছিল। ভিতরে যেতেই ও জড়িয়ে ধরলো আমাকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ! আড়ালে চোখটা মুছেই সবার সাথে কথা বলা শুরু করলো। দেহের স্নায়ু গুলো কেমন যেন করছে। লোম গুলো আলোড়িত! মধ্যাহ্নভোজন এর পর রওনা দিলাম।
মৃনাল অনন্যা আর আমি পিছে। ডিএস ড্রাইভ করছে।
মৃনাল বলল, আমরা আগে রংপুর যাবো। ওখানে ধ্রব, নাতাশা আছে।
ইকবল বলল, তাহলে গাইবান্ধা থেকে সম্পদকে ও নিয়ে আসবো।
সম্পদ। পাশের রুমে থাকা ছেলেটাকে তো ভুলেই গেছিলাম। ইস! কতো স্মৃতি আছে একসাথে।
ধ্রুব রংপুর থাকে। নাতাশা বগুড়া। বিয়ে করে নাই ওরা। পরিবারের কথা ভেবেই তারা বিয়ে করে নাই এখনো। তবে তাদের বন্ধুত্বটা আগের মতোই আছে। হয়তো কোনও অদৃশ্য বন্ধন বা কোনও অদৃশ্য বিশ্বাস এ মুড়িয়ে আছে দুইজন। কথা ,হাসি ,মজা চলছে। সাথে চলছে আমাদের বহন যান। রাস্তাটা বেশ ব্যস্ত। দুপাশে ফাঁকা বিল আর মাঝে মাঝে নীলচে সাদা পানির মিছিল। বেশ লাগছে আমার। বিকেল হয়েই এলো। বগুড়া তে আমরা। নাতাশার বাসা চিনিনা। ফোন দিয়ে ওকে আসতে বললো মৃনাল। ও টিএমএসএস এ আছে। এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, মাইক্রবায়োলজি।
আমরা অপেক্ষা করছি সাতমাথার পাশে। ১৪ বছর আগের বগুড়ার সাথে এখন এর ততোটা পার্থক্য চোখে পড়ে না। সারা দেশ যখন পরিবর্তনের মিছিলে মশগুল বগুড়ায় তখন গুটিকয়েক ভবনই উঠেছে শুধু রাজনৈতিক প্রভাব হবে হয়তো! নীলচে টয়োটা এসে থামলো আমাদের পাশে। নাতাশা বেরিয়ে এলো। মেয়েটা এখনো পিচ্চি। মিষ্টি হাসিটা এখনো আছে মুখে। খুবই স্বাভাবিক থাকার ভঙ্গিতে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু টিস্যু দিয়ে দুইবার চোখের কোনাটা মুছেনিতে আমি দেখে ফেললাম।
মানুষ বেড়ে যাচ্ছে। কাজেই নীলচে গাড়িটাও আমাদের সফরে যুক্ত হয়ে গেলো। আমি মৃণাল অনন্যা আর নাতাশা একটাতে। আর ওরা দুইজন অন্যটা তে। রংপুরে চলে এলাম। নাতাশা আগেই ধ্রবকে জানিয়ে রেখেছে। কাজেই ও রেডি হয়েই অপেক্ষা করছিলো। ধ্রুব রংপুর মেডিকেলে আছে। মেডিকেল অফিসার। খুব স্বাভাবিক ভাবেই শেষ হলো আলাপচারিতা। নিষিদ্ধ কথাটা ২-৪ কানে ভেসে এলো আমার। যাচ্ছি সম্পদকে নিতে। গাইবান্ধা পৌঁছেই সম্পদকে ফোন দিলাম। নম্বর সুইচ অফ কয়! তবে বেচারাকে খুঁজতে বেশি সময় লাগলোনা। নাম বলত সবাই চেনে ওকে। শুনলাম সে বিএমএর স্থানীয় নেতা। নাম করা ক্লিনিকও খুলেছে সে। ডাক্তারি থেকে রাজনীতিতে ঝুঁকে আছে বেশি।
আমাদের দেখেই সে বাকযুদ্ধ। আসলে কখনো কল্পনাতেও ভাবেনি সবাইকে এভাবে একসাথে দেখবে। এই ট্রিপের সবথেকে অবাক করা ব্যাপার ছিলো সম্পদের বৌ কে যখন সে ডাকলো। সবারই চোখ ছানাবড়া। তুমি! পরিচিত মুখ সবারই। সম্পদের ক্রাশ সেই ধনীর দুলালী। না মটা না হয় না ই বললাম। দুইজনেই আসলো আমাদের সাথে। রাতে থাকার জন্য খুব জোর করছিলো কিন্তু ট্রিপের সময় অল্প হওয়ায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা। এখন সংখ্যায় ৯ । আমি, সম্পদ, ডি এস আর ইকবাল একটা গাড়িতে। বাকিরা অন্য গাড়িতে।
সন্ধ্যা! চারিদিকে আঁধার নেমে গেছে। রাস্তার পাশে ততো আলো নাই তবে আজ আকাশ ঝলমলে তারায় পূর্ণ। দুপাশের আঁধার কেটে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। রাতে মৃণালের কোয়ার্টারে থাকবো। সকালে আবার যাত্রা। দুপুর নাগাত কক্সবাজার। নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো সম্পদ। হাসি দিয়ে প্রশ্ন করলো ভাইয়া, সবাই যাচ্ছে!
ইকবাল বলল, যারা দেশে আছে আর যাদের যাওয়া সম্ভব সবাই যাচ্ছে।
সম্পদ বলল, সৃষ্টি?
হকচকিয়ে গেলো সবাই। আমি নিজেই তো ভুলে গেছিলাম মেয়েটাকে। একটা সময়ে বন্ধুত্বের মাপকাঠি ছাড়িয়ে ওপরে চলে গিয়েছিল সে। তারপর। থাক না আজ। এই ট্রিপে ওই স্মৃতি নাই বা মনে করলাম। অন্য একদিন বলবো তার কথা। তবে বন্ধু হিসেবে তাকে নেওয়া যেতেই পারে। অবশ্য সে যদি চায় আর অনুমতি পায়। শুনেছি সে নাকি মোহাম্মদপুর থাকে। নেহাল টেলিটক কোম্পানিতে সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছে। সৃষ্টি একটা বেসরকারি ক্লিনিকে প্রাকটিস করে। শিশু বিশেষজ্ঞ। ভাবলাম মৃণাল কে নিয়ে ভোরে একবার যাবো ওর ওখানে। রাত ১১ টায় ঢাকা পৌঁছলাম। মৃণালের কোয়ার্টার বেশ বড়। ৯ জন থাকতে অসুবিধা হলো না।
ভোর ৫:০০। আমি আর মৃণাল রওনা দিলাম। কুয়াশার আজ বেশী মনে হচ্ছে। ঠাণ্ডা ও একটু বেশি। কলিং বাজতেই দরজা খুললও একটা মেয়ে। বাড়ির সাহায্যকারী হবে হয়তো। বললাম ভাইয়া বা আফা কাউরে ডেকে দাও। নেহাল বাইরে আসলো। এতোটাই অবাক হয়েছে যে রেগে গেলো না খুশি হলো সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। তবে খুশি হওয়ার কারণ ছিলো না এটা বাজি ধরেই বলতে পারি। সৃষ্টি আসলো। আমরা ভিতরে গিয়ে বসলাম। পুরোটা সময় আমি চুপ ছিলাম। কথা সব মৃণালই বললো। বার দুয়েক তাকিয়েছিলাম সৃষ্টির চোখের দিকে। ও স্বাভাবিক ই ছিলো। সবকিছু শোনার পর নেহাল যথারীতি রাজি হবে না। সৃষ্টি আজ ও চুপচাপ। হয়তো ভালোবাসার অধিকার। যাই হোক আমরা ওখান থেকে রওনা দিলাম। বাসায় ফিরে দেখি সবাই ই প্রস্তুত। কই গেছিলাম জানতে চাইলে এড়িয়ে গেলো মৃণাল। বললো হাওয়া খাইতে গেছিলাম।
সকাল ৮ টাতে রওনা হলাম আমরা। এবার আমি মৃণাল, ধ্রুব্ , নাতাশা আর অনন্যা একটাতে বাকি ৪ জন অন্যটাতে। আজ আকাশ বেশ পরিষ্কার। ঝলমলে রোদ। দুপাশে সারি সারি গাছ। কিছু মুহূর্ত পর পর সাঁ সাঁ করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে বড় বড় ট্রাক। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে এগিয়ে চলেছে আমাদের আড্ডা। আড্ডা এখন বেশ জমতে শুরু করেছে। কাল হয়তো ১১ বছরের গ্যাপটাই আমাদের একটু দুরে রেখেছিলো। আজ সেই আগের আমরা হয়ে গেছি। এই ট্রিপটা তে শুধু বাদ থেকে গেলো জাফরিয়া আর দুর্জয়। দুর্জয় ইন্ডিয়া গেছে। ফ্যামলি ট্যুরে। আর জাফরিয়ার খবর কেউ জানে না। নম্বরটা ও চেঞ্জ করেছে মেয়েটা।
পাহাড়ি ছায়া আর বন পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা দিগন্ত পানে। বেশ খুশি সবাই। দুপুর ১ টা। আমরা কক্সবাজার। গাড়ি ঢুকলো নিপসম এর গেট দিয়ে। ভিতরটা বেশ সাজানো। ফুলের বাগান। কিছু ভেষজ গাছও আছে। গাড়ি থেকে নামতেই গার্ড এর আগমন। আপনারা কই থেকে এসেছেন স্যার? মৃদু কণ্ঠে আওয়াজ। হয়তো কারো আসার অপেক্ষা করছিল সে। আমার মুখে ঢাকা শুনেই মুখ কালো করে ফিরে গেলো গেইটে।
আমরা গেলাম ঐশ -এর রুমে। আমাদের দেখে বেচারি কেঁদেই দিলো। কিছুক্ষণ চললো মৃদু আলাপচারিতা। তার পর অট্টহাসির রোল পড়ে গেলো। প্লান শুনে সে মহা খুশি কিন্তু আজ ইউনেস্কো থেকে ভিজিটিং টিম আসছে বলে জানালোও। বুঝলাম দারোয়ান তাদেরই অপেক্ষা করছিল। ঐশ কাল বের হওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করলো। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। আজ কক্সবাজার বিচে যাবো সে প্লানই।
বিকালে বিচে গেলাম আমরা। একসাথে আগেও আসা হয়েছে সাগর-পাড়ে। সেই ১৫ বছর আগে থার্ড ইয়ারে থাকাকালীন। তবে আজ একটু ভিন্ন, পরিপূর্ণ আমরা। তবে মজা হোক বা উপভোগ ওদিন কে হারাবে সেই সাধ্য আজ আমাদের নেই। বয়সের আড়ালে হারিয়েছে তারুণ্য। সন্ধ্যায় ফিরলাম গেস্ট হাউজে। ঐশ আমাদের সাথেই আছে এখন। রাতে ক্যাম্প ফায়ারিং হলো। ছোট্ট একটা জলসাও হলো।
সকাল ৭:২৫। আমারা রওনা হচ্ছি গন্তব্যে। সবাই মিলে ঠাসাঠাসি করে উঠলাম চাদের গাড়িতে। জ্বীপ টাইপের গাড়ি তবে কোনও ছাউনি নাই গাড়িটাতে। ডিএস গান শুরু করলো। এই পথ যদি না শেষ হয় . . . . . . . . .
আমরা চলছি মেরিন ড্রাইভ দিয়ে। একপাশে দিগন্ত জোড়া সাগর আর তার উপচে পড়া ঢেঊ আর অন্য পাশে পাহাড় , বন ,ঝর্ণা আসছে পালাক্রমে। সবাই উপভোগ করছে ভ্রমণ। সবার মুখেই এক চিলতে হাসি। টেকনাফে আছে নিপসমের জাহাজ। ওটাতেই যাবো আমরা। ঐস ব্যবস্থা করে রেখেছে।
৩ ঘণ্টা পর পৌঁছে যাবো সেন্টমার্টিন। তার পর আনন্দ শেষে ফিরবো সবাই। কাল থেকে আবার যে যার মতো ব্যাস্ত হয়ে যাবো। হয়তো আবার কেটে যাবে ১১ বছর। হয়তো বা আরো বেশি। হয়তো আমার কখনো মিলবো আমরা। কোন এক ১১ বছর পর। বয়সের ভারে আরো দুমড়ে যাবো তখন। হয়তো তখন লিখবে নতুন প্রজন্ম।
চোখটা ছলছল করছে। মুছে নিয়ে তাকিয়ে আছি দিগন্তেজোড়া সাগরের দিকে। গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, ছুটে যাচ্ছে গন্তব্যে।
ফেলে আসা দিন গুলো মনে পড়ে গেল । কখন যে এই পরিক্রমায় আমিও সহযাত্রী হয়ে গেছি মনে মনে টেরই পাই নি । স্মৃতির মাঝে ভীড় করে আসে আমারও পুরোনোদিন গুলি । শেষে এসে মনে হয়নি আবার এগারো বছর পরে দেখা হবে তো । আমার কিন্তু ভয় করে -----॥
উত্তরমুছুন