সুশীলা আর কৃষ্ণপদ হেঁটে আসছে। সুশীলা সামনে, বাঁ হাতে কৃষ্ণপদর বাঁ হাত ধরা, ডান হাতে একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালা, একটু সামনে এগোনো, কোমরের কাছে; কৃষ্ণপদর ডান হাতে ঝুলছে একটা প্লাস্টিকের থলি।
আজ হাটবার।
সুশীলা আর কৃষ্ণপদর এই হেঁটে আসা গত কুড়ি বছর ধরে প্রায় একই। হাটবারে হাটবারে। রবিবার ও বুধবার।
হাটবার অবশ্য নাগেরবাজার ছাড়িয়ে মাঝিঘাটা পর্যন্ত বেশ বোঝা যায়, আলো ফোটার পর থেকেই। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়ে। আশপাশের গ্রাম ও গঞ্জগুলো থেকে মালামাল আসে। মাঝিঘাটা কি আরো দক্ষিণে, দড়াটানা ঘাট থেকে উত্তরে নাগেরবাজার কি লঞ্চঘাট থেকে পুরানবাজার মুনিগঞ্জ পর্যন্ত সেই ভিড় বোঝা যায়। পুরোটাই নদীর কূল ঘেঁষে, কিন্তু একটু পশ্চিমে এই শহরের যে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা সেখানে হাটবারের তাপ তেমন লাগে না বেলা না বাড়লে, দুপুরের আগে পর্যন্ত। ততক্ষণে হাটবারের কেনাবেচা দু-এক দফা হয়ে গেছে। গাওগেরামের মানুষ কেউ তখন ওষুধ কি ছিটকাপড় কি লেপ-তোশকের দোকানে আসে, কি কিনতে আসে শুধু একঠোঙা বেকারি বিস্কুট। বাকি সবই নাগেরবাজারের দিকে পাওয়া যায়।

এর আগে শহরের এই অংশে সত্যি আজ যে হাটবার তা বোঝা যায় না।
শুধু এই অংশের দোকানদাররা সুশীলা আর কৃষ্ণপদকে দেখলে বোঝে, আজ হাটবার। গত কুড়ি বছর ধরেই তা বুঝে এসেছে।
কিন্তু গত কুড়ি বছরে তাদের যেমন বদল ঘটেছে, হাটবারের দিনেও বদল ঘটেছে। সে বদল অবশ্যম্ভাবী। পুরনো দোকানদাররা কেউ কেউ সে সময়ের সুশীলা আর কৃষ্ণপদকে মনে করতে পারে।
তখনো একইভাবে কৃষ্ণপদর বাঁ হাত নিজের হাতে নিয়ে সুশীলা হাঁটত। দুজনের পায়েই জুতা নেই; কিন্তু সদ্য বিয়ে হওয়া বউ সুশীলার মাথার কাপড় সরত না কখনোই। শরীরের ডান দিক দিয়ে শাড়িখানা যত দূর সম্ভব ঝুলিয়ে দিত। কালো একহারা শরীর। কপালের নিচের দিক সিঁদুরের ফোঁটা, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর। তেল দেওয়া চুল যত্ন করে আঁচড়ানো। নারকেল তেলের গন্ধ পেছনে হাঁটা কৃষ্ণপদর নাকে লাগত বাতাসের উল্টো হাঁটলে। কৃষ্ণপদ হাঁটত বুক চিতিয়ে। গরমে তার গায়ে জামা থাকত না। পেটানো শরীর। বুকে লোম। কুচকুচে কালো ওই শরীরের দিকে তাকালে মনে হতো, লোকটা চাইলে বাইচের নাও টেনে ডাঙায় তুলতে পারবে।
সুশীলার হাত ধরে সেই যে প্রতি হাটবার কৃষ্ণপদর এখানে আসার শুরু, দুপুরের আগে আগে শহরের এসব দোকানের সামনে থেকে হেঁটে যাওয়ার শুরু, আজও চলছে। সব দোকান ঘোরা শেষ হলে তারা বাজারের দিকে যায়। বাজার করে ঘরে ফেরে।
তবে এখন সুশীলার ঘোমটা অনেকখানি নেমে গেছে। মাথার প্রায় অর্ধেক দেখা যায়। একই রকম সস্তা ছাপা শাড়ি পরনে। সিঁথি ভর্তি সিঁদুর নেই, সেখানে একচিলতে রেখা, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা ছোট হয়ে গেছে। কৃষ্ণপদ আগের মতো বুক চিতিয়ে হাঁটে না। একটু যেন ঝুঁকে হাঁটে। মাঝেমধ্যে সুশীলার হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখন সুশীলাও দাঁড়ায়।
আগে সুশীলার হাতে থাকত একটা কলাইয়ের থালা, এখন অ্যালুমিনিয়ামের। কৃষ্ণপদর হাতে থাকত চটের থলি, প্লাস্টিকের, সারের বস্তা কেটে বানানো।
আর সুশীলার হাঁটার গতি কমেছে, কৃষ্ণপদরও। হয়তো কৃষ্ণপদ আগের মতো বুক চিতিয়ে হাঁটে না বলে সুশীলা গতি কমিয়েছে। এ তাদের পরস্পর জানাবোঝার বিষয়। দেখে বোঝা যায় না।
এখনো একইভাবে দোকানের সামনে থেকে হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে দাঁড়ায় সুশীলা, কৃষ্ণপদও ঘোরে। এখন ওই থালায় ঝনাৎ করে একটা এক টাকার কি পঞ্চাশ পয়সার রেজগি পড়ে। আগে, প্রথম প্রথম পড়ত পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, কি বড়জোর পঁচিশ পয়সা।
তখনো পয়সা পড়ামাত্র বিড়বিড়িয়ে ঠাকুরকে ডাকত সুশীলা, এখনো ডাকে। দোকানখানা হিন্দুর কি মুসলমানের তা সে ভাবে না। দোকানির মুখের দিকেও প্রায় তাকায় না। পাশের দোকানে যায়। আবার পয়সা পড়ে। দোকানদাররা দেয়ও। কেউ তাদের ফেরায় না। বলে না, মাফ করো। যেন ওই ছুড়ে মারা পয়সাটা তাদের জন্যই রাখা ছিল। অথবা, রাখেনি। শুধু দোকানে খদ্দের থাকলে সুশীলা দাঁড়িয়েই থাকে। কৃষ্ণপদও বোঝে দোকানে খদ্দের আছে। তারপর পয়সাটা থালায় পড়ে।
সুশীলা আর কৃষ্ণপদ সামনে এগোয়।
যে দোকানদার পয়সাটা ছুড়েছে, সে হয়তো পাশে থাকা কাউকে বলে, 'এই বউডা পারেও আইজকে কত বছোর
পাশের জন উত্তর দেয়, হয়।
তারপর নিজেদের কাজে মন দেয়। পরিচিত দৃশ্য, বহুকাল ধরে দেখা।
দুই.
মনোয়ারা আর মনোরমা দাঁড়িয়ে ছিল সিরহিন্দ মার্কেটের সামনে। এইমাত্র রিকশা থেকে নেমেছে মনোয়ারা, মনোরমা দাঁড়িয়ে ছিল। মিনিটখানেক আগেও কথা হয়েছে; কিন্তু কত দিন বাদে দেখা! মনোয়ারা নামামাত্রই মনোরমা তাকে জড়িয়ে ধরে। দুই বান্ধবীরই চোখে জল এসে গেছে।
এই সময় তাদের দিকে হেঁটে আসছে সুশীলা আর কৃষ্ণপদ।
এই দিকে রাস্তা একটু প্রশস্ত, দোকানও পাতলা। দুটো সারের দোকান। সামনে বস্তা থেকে খুলে সার ঢেলে রাখা। তারপর সেলুন। সিরহিন্দ মার্কেটের উল্টো দিকের বেশির ভাগ দোকানই সাইকেল-রিকশার পার্টসের। সামনে নতুন ভ্যান আর রিকশা তৈরি হচ্ছে। সারানো হচ্ছে কোনোটা।
সুশীলা মার্কেটের আগে আর কোনো দোকানের সামনে দাঁড়াবে না। ফলে যেন মনোয়ারা আর মনোরমার দিকেই সরাসরি হেঁটে আসে সুশীলা, কৃষ্ণপদকে নিয়ে।
সুশীলা তাদের বয়সী। প্রথম যখন মনোয়ারা আর মনোরমা তাকে দেখেছিল, তখন তারা কলেজে পড়ে। সুশীলার সবে বিয়ে হয়েছে। হয়তো একঝটকায় মনোয়ারার তা-ই মনে পড়ল। সে মনোরমাকে ছেড়ে বলল, 'দেখ সেই দুই জোন ওই অন্ধলোকটা আর তার বউ।'
মনোরমা ঘুরল। কৃষ্ণপদ আর সুশীলাকে দেখল। সেও কী যেন ভাবল। বলল, 'হু।'
'মনে আছে তোর, প্রাক্টিক্যাল খাতা কিনতি আইসে প্রথম দেহিলাম।'
'হু। তহন কেবল বিয়ে হইচে কী সুন্দর দেহাত বউডারে!'
'হয়।' মনোয়ারা বলল, 'কত দিন আগে!'
'প্রায় কুড়ি বছর আমরা ফার্স্ট ইয়ারে'৷
'এত দিন ওই ব্যাটারে নিয়েই আছে।' মনোয়ারা বলল। মনোরমা ঝট করে তাকাল মনোয়ারার দিকে। মনোয়ারা কথা শেষ করল, 'এত দিন, অন্ধ স্বামী'৷
'হু।' মনোরমা সায় দিল।
'তোগো মদ্যি বইলেই আছে আমাগো মদ্যি হলি থাকত না।'
'আইজকাইল আমাগো মদ্যিও থাকে না।'
'না থাকে থাকে'
'ওরে না, যার থাকার সে থাকে।' মনোরমা বলল।
এরপর আবার দুজনই তাকাল দুজনের দিকে। চোখের ভেতর নিজেদের বহুদিন না-দেখা হওয়া, ভালো থাকা, মন্দ থাকা খুঁজল যেন। কে কী বুঝল, কে জানে?
সুশীলা আর কৃষ্ণপদ তাদের পাশ থেকে চলে গেল। মার্কেটে ঢুকল।
মনোয়ারা আর মনোরমাও ঘুরল। দেখল।
মনোয়ারা বলল, 'থাকে কেন যে থাকে '
মনোরমা বলল, 'ভালোবাসা থাকলি থাকে ওতে ধনী-গরিব কানাখোঁড়ায় কিছু আসে-যায় না।'
মনোয়ারা সায় দিল, 'হু। দেখ, কেমন সুন্দর হাত ধইরে রইচে'
সুশীলা তখন কৃষ্ণপদর হাত ধরা। এমনি ধরে থাকে। দাঁড়িয়েছে মার্কেটের মুখে জুতার দোকানটার সামনে। আজও তাদের পায়ে জুতা নেই। কিন্তু সুশীলা কোনো জুতার দিকে তাকাল না। দাঁড়িয়ে থাকল। যেমন থাকে, থালে একটি রেজগি পড়ার অপেক্ষায়।
আজ হাটবার।
সুশীলা আর কৃষ্ণপদর এই হেঁটে আসা গত কুড়ি বছর ধরে প্রায় একই। হাটবারে হাটবারে। রবিবার ও বুধবার।
হাটবার অবশ্য নাগেরবাজার ছাড়িয়ে মাঝিঘাটা পর্যন্ত বেশ বোঝা যায়, আলো ফোটার পর থেকেই। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়ে। আশপাশের গ্রাম ও গঞ্জগুলো থেকে মালামাল আসে। মাঝিঘাটা কি আরো দক্ষিণে, দড়াটানা ঘাট থেকে উত্তরে নাগেরবাজার কি লঞ্চঘাট থেকে পুরানবাজার মুনিগঞ্জ পর্যন্ত সেই ভিড় বোঝা যায়। পুরোটাই নদীর কূল ঘেঁষে, কিন্তু একটু পশ্চিমে এই শহরের যে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা সেখানে হাটবারের তাপ তেমন লাগে না বেলা না বাড়লে, দুপুরের আগে পর্যন্ত। ততক্ষণে হাটবারের কেনাবেচা দু-এক দফা হয়ে গেছে। গাওগেরামের মানুষ কেউ তখন ওষুধ কি ছিটকাপড় কি লেপ-তোশকের দোকানে আসে, কি কিনতে আসে শুধু একঠোঙা বেকারি বিস্কুট। বাকি সবই নাগেরবাজারের দিকে পাওয়া যায়।
এর আগে শহরের এই অংশে সত্যি আজ যে হাটবার তা বোঝা যায় না।
শুধু এই অংশের দোকানদাররা সুশীলা আর কৃষ্ণপদকে দেখলে বোঝে, আজ হাটবার। গত কুড়ি বছর ধরেই তা বুঝে এসেছে।
কিন্তু গত কুড়ি বছরে তাদের যেমন বদল ঘটেছে, হাটবারের দিনেও বদল ঘটেছে। সে বদল অবশ্যম্ভাবী। পুরনো দোকানদাররা কেউ কেউ সে সময়ের সুশীলা আর কৃষ্ণপদকে মনে করতে পারে।
তখনো একইভাবে কৃষ্ণপদর বাঁ হাত নিজের হাতে নিয়ে সুশীলা হাঁটত। দুজনের পায়েই জুতা নেই; কিন্তু সদ্য বিয়ে হওয়া বউ সুশীলার মাথার কাপড় সরত না কখনোই। শরীরের ডান দিক দিয়ে শাড়িখানা যত দূর সম্ভব ঝুলিয়ে দিত। কালো একহারা শরীর। কপালের নিচের দিক সিঁদুরের ফোঁটা, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর। তেল দেওয়া চুল যত্ন করে আঁচড়ানো। নারকেল তেলের গন্ধ পেছনে হাঁটা কৃষ্ণপদর নাকে লাগত বাতাসের উল্টো হাঁটলে। কৃষ্ণপদ হাঁটত বুক চিতিয়ে। গরমে তার গায়ে জামা থাকত না। পেটানো শরীর। বুকে লোম। কুচকুচে কালো ওই শরীরের দিকে তাকালে মনে হতো, লোকটা চাইলে বাইচের নাও টেনে ডাঙায় তুলতে পারবে।
সুশীলার হাত ধরে সেই যে প্রতি হাটবার কৃষ্ণপদর এখানে আসার শুরু, দুপুরের আগে আগে শহরের এসব দোকানের সামনে থেকে হেঁটে যাওয়ার শুরু, আজও চলছে। সব দোকান ঘোরা শেষ হলে তারা বাজারের দিকে যায়। বাজার করে ঘরে ফেরে।
তবে এখন সুশীলার ঘোমটা অনেকখানি নেমে গেছে। মাথার প্রায় অর্ধেক দেখা যায়। একই রকম সস্তা ছাপা শাড়ি পরনে। সিঁথি ভর্তি সিঁদুর নেই, সেখানে একচিলতে রেখা, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা ছোট হয়ে গেছে। কৃষ্ণপদ আগের মতো বুক চিতিয়ে হাঁটে না। একটু যেন ঝুঁকে হাঁটে। মাঝেমধ্যে সুশীলার হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখন সুশীলাও দাঁড়ায়।
আগে সুশীলার হাতে থাকত একটা কলাইয়ের থালা, এখন অ্যালুমিনিয়ামের। কৃষ্ণপদর হাতে থাকত চটের থলি, প্লাস্টিকের, সারের বস্তা কেটে বানানো।
আর সুশীলার হাঁটার গতি কমেছে, কৃষ্ণপদরও। হয়তো কৃষ্ণপদ আগের মতো বুক চিতিয়ে হাঁটে না বলে সুশীলা গতি কমিয়েছে। এ তাদের পরস্পর জানাবোঝার বিষয়। দেখে বোঝা যায় না।
এখনো একইভাবে দোকানের সামনে থেকে হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে দাঁড়ায় সুশীলা, কৃষ্ণপদও ঘোরে। এখন ওই থালায় ঝনাৎ করে একটা এক টাকার কি পঞ্চাশ পয়সার রেজগি পড়ে। আগে, প্রথম প্রথম পড়ত পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, কি বড়জোর পঁচিশ পয়সা।
তখনো পয়সা পড়ামাত্র বিড়বিড়িয়ে ঠাকুরকে ডাকত সুশীলা, এখনো ডাকে। দোকানখানা হিন্দুর কি মুসলমানের তা সে ভাবে না। দোকানির মুখের দিকেও প্রায় তাকায় না। পাশের দোকানে যায়। আবার পয়সা পড়ে। দোকানদাররা দেয়ও। কেউ তাদের ফেরায় না। বলে না, মাফ করো। যেন ওই ছুড়ে মারা পয়সাটা তাদের জন্যই রাখা ছিল। অথবা, রাখেনি। শুধু দোকানে খদ্দের থাকলে সুশীলা দাঁড়িয়েই থাকে। কৃষ্ণপদও বোঝে দোকানে খদ্দের আছে। তারপর পয়সাটা থালায় পড়ে।
সুশীলা আর কৃষ্ণপদ সামনে এগোয়।
যে দোকানদার পয়সাটা ছুড়েছে, সে হয়তো পাশে থাকা কাউকে বলে, 'এই বউডা পারেও আইজকে কত বছোর
পাশের জন উত্তর দেয়, হয়।
তারপর নিজেদের কাজে মন দেয়। পরিচিত দৃশ্য, বহুকাল ধরে দেখা।
দুই.
মনোয়ারা আর মনোরমা দাঁড়িয়ে ছিল সিরহিন্দ মার্কেটের সামনে। এইমাত্র রিকশা থেকে নেমেছে মনোয়ারা, মনোরমা দাঁড়িয়ে ছিল। মিনিটখানেক আগেও কথা হয়েছে; কিন্তু কত দিন বাদে দেখা! মনোয়ারা নামামাত্রই মনোরমা তাকে জড়িয়ে ধরে। দুই বান্ধবীরই চোখে জল এসে গেছে।
এই সময় তাদের দিকে হেঁটে আসছে সুশীলা আর কৃষ্ণপদ।
এই দিকে রাস্তা একটু প্রশস্ত, দোকানও পাতলা। দুটো সারের দোকান। সামনে বস্তা থেকে খুলে সার ঢেলে রাখা। তারপর সেলুন। সিরহিন্দ মার্কেটের উল্টো দিকের বেশির ভাগ দোকানই সাইকেল-রিকশার পার্টসের। সামনে নতুন ভ্যান আর রিকশা তৈরি হচ্ছে। সারানো হচ্ছে কোনোটা।
সুশীলা মার্কেটের আগে আর কোনো দোকানের সামনে দাঁড়াবে না। ফলে যেন মনোয়ারা আর মনোরমার দিকেই সরাসরি হেঁটে আসে সুশীলা, কৃষ্ণপদকে নিয়ে।
সুশীলা তাদের বয়সী। প্রথম যখন মনোয়ারা আর মনোরমা তাকে দেখেছিল, তখন তারা কলেজে পড়ে। সুশীলার সবে বিয়ে হয়েছে। হয়তো একঝটকায় মনোয়ারার তা-ই মনে পড়ল। সে মনোরমাকে ছেড়ে বলল, 'দেখ সেই দুই জোন ওই অন্ধলোকটা আর তার বউ।'
মনোরমা ঘুরল। কৃষ্ণপদ আর সুশীলাকে দেখল। সেও কী যেন ভাবল। বলল, 'হু।'
'মনে আছে তোর, প্রাক্টিক্যাল খাতা কিনতি আইসে প্রথম দেহিলাম।'
'হু। তহন কেবল বিয়ে হইচে কী সুন্দর দেহাত বউডারে!'
'হয়।' মনোয়ারা বলল, 'কত দিন আগে!'
'প্রায় কুড়ি বছর আমরা ফার্স্ট ইয়ারে'৷
'এত দিন ওই ব্যাটারে নিয়েই আছে।' মনোয়ারা বলল। মনোরমা ঝট করে তাকাল মনোয়ারার দিকে। মনোয়ারা কথা শেষ করল, 'এত দিন, অন্ধ স্বামী'৷
'হু।' মনোরমা সায় দিল।
'তোগো মদ্যি বইলেই আছে আমাগো মদ্যি হলি থাকত না।'
'আইজকাইল আমাগো মদ্যিও থাকে না।'
'না থাকে থাকে'
'ওরে না, যার থাকার সে থাকে।' মনোরমা বলল।
এরপর আবার দুজনই তাকাল দুজনের দিকে। চোখের ভেতর নিজেদের বহুদিন না-দেখা হওয়া, ভালো থাকা, মন্দ থাকা খুঁজল যেন। কে কী বুঝল, কে জানে?
সুশীলা আর কৃষ্ণপদ তাদের পাশ থেকে চলে গেল। মার্কেটে ঢুকল।
মনোয়ারা আর মনোরমাও ঘুরল। দেখল।
মনোয়ারা বলল, 'থাকে কেন যে থাকে '
মনোরমা বলল, 'ভালোবাসা থাকলি থাকে ওতে ধনী-গরিব কানাখোঁড়ায় কিছু আসে-যায় না।'
মনোয়ারা সায় দিল, 'হু। দেখ, কেমন সুন্দর হাত ধইরে রইচে'
সুশীলা তখন কৃষ্ণপদর হাত ধরা। এমনি ধরে থাকে। দাঁড়িয়েছে মার্কেটের মুখে জুতার দোকানটার সামনে। আজও তাদের পায়ে জুতা নেই। কিন্তু সুশীলা কোনো জুতার দিকে তাকাল না। দাঁড়িয়ে থাকল। যেমন থাকে, থালে একটি রেজগি পড়ার অপেক্ষায়।
সৌজন্যে : কালেরকণ্ঠ : ঢাকা, শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১, ১৫ আশ্বিন ১৪১৮, ১ জিলকদ ১৪৩২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন