Stories

একটু দেখবেন, স্যার -

ঢাকুরিয়া লেকটা ঝিম ধরে আছে। হাওয়া নেই তেমন। চারদিকে এখনও ভোরের আবছা কুয়াশা। খানিকটা গেলেই দৃষ্টিটা আটকে যাচ্ছে। তবু তার মধ্যেই কী ভিড়! কাতারে কাতারে মর্নিংওয়াক করতে বেরিয়ে পড়েছে লোক।
নানা মাপের নানা আকারের এক সুসজ্জিত বিশাল বাহিনী। দেখার মতো দৃশ্য! সবাই চুপচাপ হেঁটে চলেছে হনহন করে। আর কোনও দিকে কারও লক্ষ্য নেই। কোনও কথাও না।
মাথার ওপর পাখি ডেকে যাচ্ছে তাদের অবিরাম। বুলবুলি, বসন্তবউরি, মাছরাঙা, দোয়েল... হাওয়ায় ম ম করে নাগকেশর আর মুচকুন্দ চাঁপার গন্ধ। কুয়াশার মধ্যে কোথা থেকে সাঁ সাঁ করে উড়তে উড়তে এসে পানকৌড়ি ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জলে...
না। কেউ কোনও খেয়াল করে না। আপাতত একটাই লক্ষ্য সবার। সোজা শুধু হাঁটা। অথবা জগিং। নির্দিষ্ট কোটাটা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এ রকমই চলবে। তারপর শেষে জলের ধারে কোনও বেঞ্চিতে বসে একটু গল্পগুজব কিছুক্ষণ। রাজনীতি, খেলা বা অন্য কোনও বিশেষ খবর নিয়ে জোর আলোচনা খানিক। গলা চড়িয়ে ব্যাপারটা কথা কাটাকাটিতেও পৌঁছে যায় কখনও। তবে সে সব এখন নয়।
জারুলের ডালে ফুল এসে গেছে থোকা থোকা। বিশাল অর্জুন গাছটার মাথায় চলছে এক সীমানা দখলের লড়াই। দুটো চিল আর এক ঝাঁক টিয়ার। গোটা আকাশ জুড়ে এখন তার কী চিল চিৎকার...
না, কেউ মাথা ঘামায় না এ সব নিয়ে। চোখ তুলে দেখেও না কেউ। এখন যেন একমাত্র কাজ শুধুই কেবল হেঁটে চলা প্রাতর্ভ্রমণকারীদের। অন্য আর কোনও তুচ্ছ ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়া নয়।
অবশ্য মাঝে মধ্যে একটু আধটু ব্যতিক্রম যে ঘটছেই না, এমন নয়। সন্ধানী দু-একজনের নজর ঠিক ঘোরে আশপাশে। চেনা দেখলে কথাও হচ্ছে হঠাৎ দু-একটা। বা হাল্কা কোনও রসিকতা। যেমন এই মুহূর্তেই:
— আরে, মুখার্জিদা যে! গুড মর্নিং। ভাল আছেন তো—
— মর্নিং, মর্নিং। এই চলে যাচ্ছে এক রকম...
— আমাদের দিকেও একটু দেখবেন, দাদা...
— এই তো পরিষ্কার দেখছি। কী সুন্দর একখানা টুপি চড়িয়েছেন মাথায়। না দেখে কি উপায় আছে! হা হা...
— কিন্তু সেটা নিজেরই মাথায়... হা হা...
অন্য দিকে সাফারি পার্কের এ পাশে ঝুপসি কৃষ্ণচূড়াটার নীচে শোনা যায় অন্য রকম এক সংলাপ:
— হাই দীয়া— কী সুন্দর লাগছে রে তোকে দেখতে।
— তাই! থ্যাঙ্ক য়ু! কিন্তু তুই যে আজ একা মল্লি?
— রোজ আর দোকা কোথায় পাচ্ছি! আমি তো একাই!
— আহা রে! দাঁড়া, আমিই তা হলে দেখছি ব্যাপারটা তোর।
— দেখবি? দ্যাখ না ভাই প্লিজ—
মল্লির গলায় যেন মিনতির সুর।
তারপরই চাপা হাসির ঝলক দু’ দিকে দুজনের। হাসতে হাসতেই মিলিয়ে গেল এবার ছায়ামূর্তি দুটো।
শব্দটাই শুধু রিনরিন করে বাজে একটুক্ষণ সকালের ঝিম ধরা চাপা হাওয়ায়।
খানিকটা এগিয়ে গেলে ও দিকের প্রকাণ্ড সবুজ খেলার মাঠটা আবার অন্য রকম। একেবারেই শুনশান এখন। কেউ কোথাও নেই। ঘাসগুলো সব শিশিরে ভিজে চপচপে। ঝিরঝিরে সুন্দর হাওয়া খেলছে মাঠ জুড়ে।
সবুজ হাওয়া রবীন্দ্র সরোবরের! প্রথম বসন্তের হাওয়া!
একটু দাঁড়ালেই কাছে গন্ধ আসে নাকে। ফুল আর ঘাসের। রাধাচূড়া ফুল পড়ে আছে অনেক। সবুজ ঘাসের ওপর সার সার সোনালি-হলুদ ফুল! নেশা ধরে যায় যেন তাকিয়ে থাকলে...
কিন্তু দৃশ্যটা উপভোগ করার মতন তেমন কেউ নেই কাছাকাছি। একজনকেই শুধু চোখে পড়ে। মাথায় মাফলার জড়ানো, দীর্ঘদেহী, সুদর্শন একজন মানুষ। ভাবুকের মতো যিনি গভীর কোনও চিন্তায় মগ্ন। অন্য কোনও দিকেই যেন তাঁর কোনও দৃষ্টি নেই।
নিঃসঙ্গে আত্মমগ্ন মানুষটি এই মুহূর্তে শুধু মাঠের চারদিকে পাক খেয়েই চলেছেন। কথা বলার মতো তাঁর অন্য একটি মানুষও নেই কাছাকাছি। একটু অবাকই লাগে প্রথম দৃষ্টিতে।
পরে মনে হয়, না, কোনও আশ্চর্য কিছু নয়। হয়তো ভদ্রলোক একটু একা একাই ঘুরতে চান। সবার থেকে আলাদা হয়ে তিনি এখানেই তাঁর মর্নিং ওয়াকটি সেরে নিচ্ছেন। খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
তবু ঘটনাটি চোখে পড়ার মতো।
আর, একটু নজর করে থাকলে, মানুষটি যে একেবারেই একা, তাও মনে হয় না। কারণ তাঁর হাতের মধ্যে দেখা যায় স্পষ্ট একটা মিনি সাইজের ট্রানজিস্টার। এফ এম চ্যানেলে যেখানে এখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। ভল্যুমটা খুব কমিয়ে তিনি সেটাই এখন শুনছেন হাঁটতে হাঁটতে: এই যে তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ... এই যে পাতায় আলোয় নাচে সোনার বরণ...
গানটা শেষ হতে না হতেই ও দিকে এক শ্রোতাবন্ধুর ফোন, হ্যালো—
এ দিকে প্রশ্ন— হ্যাঁ, কে বলছেন আপনি?
— দিদিভাই, নমস্কার। অনেকদিন পর আপনার টেলিফোন পেলাম। কী যে ভাল লাগছে... আপনি ভাল আছেন তো দিদিভাই...
— হ্যাঁ ভাই, আপনার নামটা বলুন আগে...
— গুরুচরণ বৈদ্য, দিদিভাই...
— কোথা থেকে বলছেন আপনি?
— আজ্ঞে গোচরণ, দিদিভাই।
— হ্যাঁ, এবার আপনি বলুন ভাই...
— বলছিলাম যে, সকালবেলায় এ সব গান শুনলে মনের মধ্যে কী রকম যে একটা আঁকুপাকু করতে থাকে, ঠিক বলে বোঝানো যায় না... মনে হয় যেন কোথায় আমরা! চারদিকে খালি ময়লা আর মতলববাজি, দলাদলি আর খেয়োখেয়ি... তার মধ্যে ওই নীল আকাশটা... সকালের ফটফটে আলোয় কী যে দারুণ এক...
— ঠিক আছে ভাই। কট করে এবার এফ এম দিদি থামিয়ে দিলেন শ্রোতাবন্ধুটিকে। বললেন, আপনি শুনতে থাকুন আরও...
সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় নতুন গান: আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে... আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে...
দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক পায়চারি করতে করতেই সুরটা ভাঁজেন একটু মনে মনে। বরাবরই তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত। তালিমও নিয়েছিলেন এর, একসময় দক্ষিণীতে। টানটা কাটেনি আজও পুরোপুরি।
এই মুহূর্তে এফ এম চ্যানেলের এই অনুষ্ঠানই তাঁর অতিপ্রিয় এক ভ্রমণসঙ্গী। আর দ্বিতীয় সঙ্গী, তাঁর বুকপকেটের খুদে মোবাইল ফোনটি। মাঝে মধ্যে সেখানেও সাড়া উঠছে গানের পাশাপাশি। ভদ্রলোক খুবই সজাগ সে দিকেও।
একটু আগেই ফোন এল একটা। তিনিও যেন ডায়াল করলেন কাকে খুবই ব্যতিব্যস্ত হয়ে। কিন্তু কথা কিছু হল না। মন্ত্রিমহোদয়ের নাকি এখনও ঘুমই ভাঙেনি। কালও নাকি লেট নাইট প্রোগ্রাম ছিল তাঁর। এই নিয়ে পর পর দু’ দিন হল।
শিট্! শব্দটা মনে একবার উঁকি দিয়ে গেলেও মুখে আসে না তাঁর। কারণ, মানুষ হিসেবে তিনি খুবই নম্র এবং মধুরভাষী। সেভাবেই মন্ত্রীর সহকারী নিশীথবাবুর সঙ্গে দু-একটা কথা বলেই ফোনটা ছেড়ে দিলেন।
রেডিওতে নতুন গান শুরু হয়ে গেছে এ দিকে: সকালবেলার আলোয় বাজে বিদায় ব্যথার ভৈরবী...
শুনতে শুনতে হঠাৎ যেন একটা নিশ্বাস পড়ে মানুষটির। চোখের সামনে তিনি সহসা একটা বিদায় অনুষ্ঠানের ছবি দেখতে থাকেন। বিদায়। আর মনটাও যেন মুষড়ে যেতে থাকে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে। ফুল মালা করতালি উপহার...
অথচ কোনও কারণ নেই এর। চোখের সামনে রাধাচূড়ার ডালগুলো তেমনি দোল খেয়ে চলেছে। মনমাতানো হু হু হাওয়ায় ফুলগুলো তেমনি ঝরে পড়ছে টুপটাপ। এক অদ্ভুত উল্লাসের ছবি তার চারদিকে। ডাক ছেড়ে যেন কেউ বলছে— দ্যাখো, শুধু আমাদের দিকেই দ্যাখো এখন, আর কিছু নয়, আর কিছু নয়...
ঝকমক করছে ঘাসের ওপর হলুদ ফুলগুলো। কুয়াশা কেটে গিয়ে দৃশ্যটা আরও উজ্জ্বল এখন। মগ্ন হয়ে মানুষটি সে দিকেই দেখতে থাকেন একটু। এই যে তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ...
সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ে রেলিংয়ের ও ধারেই একটি ছায়ামূর্তি। গাছের আড়াল থেকে একদৃষ্টিতে লক্ষ্য রাখছে তাঁর দিকে। খুবই চেনা-চেনা মুখ। পরক্ষণেই চোখটা সরিয়ে নিলেন তিনি। গান শোনেন আবার মন দিয়ে। এটাই যেন এখন একমাত্র আশ্রয় তাঁর!
হ্যাঁ, এই মানুষটিই হলেন পিনাকপাণি দত্ত। যারা জানে, তারা সবাই এক ডাকে চেনে ব্যক্তিটিকে।
লোকেরা যাঁকে বলে দত্তসায়েব। বন্ধুরা সবাই, পি পি। সরকারি দফতরের সর্বময় কর্তা একজন। কলমের একটি খোঁচায় প্রায় হয়কে নয়, বা নয়কে ছয় করে দেবার মতো ক্ষমতা ধরেন যিনি। ডাকসাইটে টেকনোক্র্যাট হিসেবেও প্রভূত প্রতিপত্তি তাঁর সরকারি মহলে।
অথচ মানুষ হিসেবে দত্তসায়েব খুবই শান্ত মেজাজের। শান্ত, নম্র এবং মধুরভাষী। হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও মুখে হাসিটি লেগেই আছে। অকারণেই অফিসে দর্শনার্থীদের লাইন পড়ে যায় সায়েবের একবার দেখা পাওয়ার জন্য।
এমন কী এই সাতসকালেও এখানে এসে দু-চারজন আড়ালে আবডালে গা-ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সায়েবের ভ্রমণপর্বটা শেষ হলেই সুড়সুড় করে ঠিক বেরিয়ে আসবে। অফিসের বদলে এই জায়গাটাই পছন্দ অনেকের। এখানেই যেন কাজ ভাল হয়। ভোরবেলার দত্তসায়েবকে সম্পূর্ণ এক অন্য মেজাজে ধরা যায়। তাই ভিড়টা রোজ এমন লেগেই থাকে।
আজও তেমনি আছে অনেকে আশেপাশে গা-ঢাকা দিয়ে। এবং তার মধ্যেই যথারীতি চলে সায়েবের ভ্রমণপর্ব। হাঁটাটা শেষ হলেই দেখা যাবে হালকা কিছু ব্যায়াম। অতঃপর মাঠ ছেড়ে দুলকি চালে বটতলার চায়ের স্টলে গিয়ে দাঁড়ানো। চা-পান আর বন্ধুজনের সঙ্গে খানিক আড্ডা। মোটামুটি এই রকমই চলে রুটিনটা তাঁর রোজ সকালের।
কিন্তু আজ যেন কিছুতেই তেমন মন নেই পি পি-র। দূরের আকাশ দেখতে দেখতে চাপা নিশ্বাস ফেলেন একটা। আর কী! সবই তো শেষ! সামনে আর মাত্র ছ’টা মাস! তার পরই অফিসের সাজানো রাজ্যপাট ছেড়ে চলে যেতে হবে অখণ্ড এক অবসর জীবনে!
কানের মধ্যে কেউ যেন এখন প্রায়ই ফিসফিস করে: বিদায় পি পি! বিদায়! তোমার খেলা শেষ। এবার থেকে দায়মুক্ত একজন সাধারণ মানুষ তুমি। অফিসের আর কেউ নও। সব কিছু মেনে নেওয়ার জন্যে এখন থেকেই প্রস্তুত হও পি পি...
কিন্তু না। এত সহজে হাল ছাড়তে রাজি নন তিনি। একটা কিছু করা দরকার। শরীরটা এখনও পুরোপুরি সুস্থ সবল তাঁর। যে কোনও জটিল সমস্যার সমাধান করে ফেলেন এখনও সবচেয়ে আগে। আর তাকেই কিনা চলে যেতে হবে এবার! অন্তত আরও কিছুদিন থাকা প্রয়োজন তাঁর এই পদে। দফতরের জন্যেও বটে, তাঁর নিজের জন্যেও বটে!
মুশকিল হচ্ছে, ছোটখাট কোনও পদে থাকলে চাকরির মেয়াদ বাড়ানো কোনও সমস্যা নয় তেমন। কিন্তু তাঁর বিভাগীয় প্রধানের এই পদটিতে, সেটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কী যে হবে শেষ পর্যন্ত, কে জানে!
তবে আশার একটা ক্ষীণ আলো যেন দেখতে পাচ্ছেন চোখের সামনে। কিছুই বলা যায় না এখনও।
সামনে বছরটা ঘুরলেই ইলেকশান। আর ভোটপর্ব মানেই তো একটা বিরাট ডামাডোল গোটা অফিস জুড়ে। ‘এ লড়াই বাঁচার লড়াই...’। মন্ত্রিমহোদয়ের একেবারে রাতের ঘুম কেড়ে ছাড়বে পাবলিক চারদিক থেকে। উঠবে একটার পর একটা অভিযোগ। তখন? হ্যাঁ, এই সুযোগটাই এখন কাজে লাগাতে হবে ভেবে চিন্তে।
অতএব মহাশয়, আপনার একান্ত অনুগত পিনাকপাণি দত্তর চাকরির মেয়াদটা আরও কিছুকাল বাড়ানো হোক। অন্তত সামনের ইলেকশানটা পার হওয়া পর্যন্ত— পাবলিকের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবেই এটা প্রয়োজন স্যার...
— এই মর্মে খুবই সুচিন্তিত ভাষায় তিনি মন্ত্রীর কাছে একটি আবেদনপত্র জমা দিয়ে রেখেছেন।
ব্যাপারটা অবশ্য খুবই গোপন এখনও। একমাত্র বিভাগীয় সেক্রেটারি সায়েবের যা জানা। তাঁকেই বলে যা করার করেছেন।
এখন ফলাফলের জন্যে শুধু অপেক্ষা। মনের মধ্যে কথাটা তাঁর ঘুরপাক খেয়েই চলেছে। অথচ বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। গান শুনতে শুনতে দীর্ঘদেহী মানুষটি সেই মাঠময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন একা একা।
দু’ দিন আগে সেক্রেটারি সায়েবকেই ফোন করে ক’বার তাগাদা দিয়েছেন যা।
সেক্রেটারি পরামর্শ দেন, পি পি, এভাবে হবে না। নিজেই একবার সরাসরি কথা বলুন আপনি মন্ত্রীর সঙ্গে...
— স্যার, আমি? সেটা কি ভাল দেখাবে...
— কেন নয়? নিজেরটা তো নিজেই বলবেন এখন। ওঁর এলাকায় এত যে কাজ করলেন আপনি, নতুন নতুন রাস্তা, দু-দুটো ব্রিজ, তার ওপর একগাদা হবু প্রকল্পের শিলান্যাস! সে কি এমনি এমনি নাকি! ইলেকশান মিটিংয়ে এ সব নিয়েই তো গলা ফাটাবেন আপনার মন্ত্রী। তাই নয়?
— সে তো নিশ্চয়ই স্যার, সে তো নিশ্চয়ই...
— তবে? এখন চুপ করে থাকলে চলবে কেন! সরাসরি বাড়িতেই ফোন করে কথাটা বুঝিয়ে বলুন ভাল করে। কাজ হবে, দেখবেন—
— ঠিক আছে... স্যার...
— আর হ্যাঁ, ফোনটা কিন্তু রাত্তিরে করবেন না। ভদ্রলোকের মুডটা তখন একটু বেহাল থাকে কিন্তু...
— তবে কি সন্ধের দিকে?
— না না। ভোরবেলায় ঘুম ভাঙার পরেই করুন না। দেখবেন মেজাজটা বেশ ফুরফুরে আছে মন্ত্রিমহোদয়ের।
— ঠিক আছে স্যার... থ্যাঙ্ক য়ু... স্যার...
দত্ত সায়েবের ভ্রমণপর্ব শেষ। ধীরে ধীরে মাঠের পুব দিকে সরে এলেন। শুরু হল তাঁর নিত্যদিনের শরীরচর্চার রুটিন। প্রথমেই হাত দুটো আকাশে তোলা আর নামানো। বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়েই চলতে থাকে ব্যাপারটা। পরে কোমর বাঁকিয়ে এটাই চলে আবার অন্য আর এক ভঙ্গিতে।
সব শেষে শুরু, হাত দুটো দু’ পাশে রেখে বিচিত্র ভঙ্গিতে তাঁর কোমর দোলানো। এটাই শেষ আইটেম। ট্রানজিস্টারটা তখন হিপ্ পকেটে। সেখানেই বেজে যায়। পথ চলতি আশেপাশে অনেকে সকৌতুকে একবার দেখেও তাকিয়ে। সায়েবের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। মিনিট পনেরো প্রায় এভাবেই ব্যায়াম আর গান শোনা একসঙ্গেই চলে।
সব শেষ হলে, একবার চারদিকে নজর করে দেখেন ভাল করে। তার পরই দুলকি চালে সোজা এগিয়ে যান পুজনের চায়ের স্টলে।
রাস্তা পেরোলেই বটতলায় পুজনের চায়ের স্টল। একধারে দোকান। অন্য দিকে শিবমন্দির। জমজমাট পরিবেশ যেন ফুটপাতটা জুড়ে। লোক রোজ ঠাকুরপ্রণাম আর চা খাওয়াটা একসঙ্গেই সারে এখানে। দত্ত সায়েবও তার ব্যতিক্রম নন।
প্রণাম সেরে তিনি বটতলায় দাঁড়াতেই এবার ছবিটা পাল্টে যায়। চারদিক থেকে অনেকগুলো মুখ গুটি গুটি এগিয়ে আসতে থাকে তাঁকে লক্ষ করেই। কেউ মাথা চুলকোয়, কেউ হাসে, কেউ দুটো হাত কচলায়। আর সেলাম করে বারবার।
চিংড়ি এখন বেকার। আশায় আছে দত্ত সায়েবকে ধরে যদি কিছু একটা হিল্লে হয়ে যায়।
নিজে না খেয়েও তাই চায়ের ভাঁড়গুলো থালায় সাজিয়ে রোজ সে সামনে এনে ধরে। চিনি-ছাড়া এবং চিনি দেওয়া। পিনাকপাণি লম্বা হাতে সবার আগে তাঁর চিনি-ছাড়া ভাঁড়টা তুলে নেন। তারপর চা খেতে খেতেই হাসি মুখে আর্জিগুলো শুনতে থাকেন সবার।
ইন্দার সুরেখার কোটি টাকার কাজ আটকে গেছে। লাখ টাকা সেলামি নিয়েও এখন নতুন ফ্যাকড়া তুলছেন এম এল এ সায়েব।
কাঁচুমাচু মুখে মিনতি করে ইন্দার, স্যার, আপনি একটু দেখুন... যদি আরও কিছু লাগে, না হয়... সব কাম কারবার বন্ধ আমার একেবারে...
— ঠিক আছে। আমি দেখছি। পিনাকপাণি মাথা নাড়লেন।
জগন্নাথবাবুর আর্জি একটা বিজ্ঞাপন। পাড়ার বইমেলার জন্য। সকাল থেকে অনেকক্ষণ ঘুরঘুর করেছেন গাছতলায় তিনি আশায় আশায়।
পিনাকপাণি বললেন, কত টাকা জগাদা?
— হাজার পাঁচেক হলেই পাড়ায় মুখটা রক্ষা হয় আমার, ভাই...
দত্তসায়েব বাঁ দিকে তাকালেন, ইন্দার একটা বিজ্ঞাপন দাও না, বইমেলায়।
— বয়ঐ মেলা! ঠিক আছে স্যার...
বিশু মাঝখান থেকে একটা বিড়ি ধরিয়ে বলল, আমাদের বাংলোটা দিঘার। শনি, রবি দু’ দিন কিন্তু... হবে তো?
পিনাকপাণি মাথা নাড়েন, দেখছি।
— আর আমার সেই গাড়ি, পিনুদা...
মনা বলে উঠল, এবার দুটো চাই কিন্তু—
— দুটো! কপাল কুঁচকে একটু ভাবেন তিনি। দুটো পারব কি...
— না না, এটা আমার প্রেস্টিজের ব্যাপার পিনুদা, বউ, শালি সবাইকেই বলে রেখেছি তারাপীঠ যাব, আপনাকে পারতেই হবে...
পাল শুকনো মুখে এগিয়ে আসে, দাদা আমার পেমেন্টটা যে অনেকদিন আটকে আছে...
— কেন, কী হল আবার?
— মজুমদার ঘোরাচ্ছে রোজই, আজ না কাল করে...
— তাই! ঠিক আছে আমি দেখছি। তুমি বুধবার বিকেলে একবার...
কথার মধ্যেই বুক পকেটে ফোন বেজে উঠল। সবাই চুপ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
— হ্যালো।
— হ্যালো। পি পি, তুমি ফোন করেছিলে সকালে...
মন্ত্রীর ফোন! সঙ্গে সঙ্গেই শিরদাঁড়াটা টানটান দত্তসায়েবের।
— হ্যাঁ। হ্যাঁ স্যার, আমি মানে আমার ওই কেসটার ব্যাপারে...
— ফাইলটা তো তোমার, টেবিলেই আছে, আমার। সময় হলেই দেখব, অ্যাঁ?
— হ্যাঁ স্যার। কাইণ্ডলি একটু দেখবেন স্যার...
লাইনটা ও দিকে কট্ করে কেটে গেল ততক্ষণে। পিনাকপাণি হতভম্ব। মনটা যেন বোঝা গেল না মন্ত্রিমহোদয়ের। কথাটাও যেন কেমন কাটা কাটা।
মনা অবাক হয়ে তাকায়, সে কি আপনিও পিনুদা! শেষে দেখতে বলছেন একটু আপনার কেসটাও? তাজ্জব ব্যাপার! লোকটা কে?
দত্তসায়েবের মুখে অদ্ভুত হাসি, হ্যাঁ আমিও। কেউ আলাদা নই। তুমি, আমি, আমরা সবাই... ধরাধরি করেই তো আছি।
বিশু মাথা নাড়ে, ঠিক, যা দিনকাল! একজন না একজনকে ধরতেই হয় এখন...
চিংড়ির মুখে একগাল হাসি, আমি তো সেই জন্যে, রোজ সকালে একবার শিবঠাকুরকে পেন্নাম ঠুকে বলি, খালি তুমি একটু দেখো বাবা। তা হলেই সব হয়ে যাবে আমার।
মনা মাথা নাড়ে, ওটা তোর বউকেই করতে বল। তুই বরং মন দিয়ে পিনুদার সেবাটা করে যা। তাতেই ফল পেয়ে যাবি একদিন হাতে হাতে।
পিনাকপাণি কোনও মন্তব্য করেন না। শুধু মিটিমিটি হাসেন। আর উপভোগ করেন চারদিকের এই বিচিত্র সংলাপগুলো।
যদিও মনের গভীরে ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়েই যাচ্ছে তাঁর মন্ত্রিমহোদয়ের শেষ কথাটা— সময় হলেই দেখব। অ্যাঁ? এটা কি কোনও আশ্বাস, নাকি এক ধাঁধা! ঠিক বুঝতে পারেন না পিনাকপাণি।
সৌজন্যে: আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ ফাল্গুন ১৪০৯ রবিবার ৯ মার্চ ২০০৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কথামালা Designed by Templateism | Blogger Templates Copyright © 2014

mammuth থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.